Noarin Afroz Miss - After Mid topic

 (*) means the importance of the question

*** very very important  ( 7 questions- 1,3, 6,8,9,10,15) 

** important ( 5 questions- 5,7,11,13,14 )

* less important ( 3 questions- 2,4,12 ) 


Q1. আয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ও শাসনের বৈশিষ্ট্য  ***

পাকিস্তানের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি আয়ুব খান (গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসা প্রথম মিলিটারি শাসক) ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তাঁর ক্ষমতা দখল ও শাসনের পটভূমি এবং শাসনের বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি মৌলিক পরিবর্তন আনে। এখানে তাঁর শাসন ও ক্ষমতা দখলের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. আয়ুব খানের ক্ষমতা দখল (1960)

পটভূমি:

১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্তান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংকটের সম্মুখীন ছিল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান একটি সংবিধান গ্রহণ করলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একাধিক বিরোধ এবং অসামঞ্জস্যতা ছিল। এর পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সামরিক শক্তির প্রয়োগ করেন এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান, আয়ুব খান, কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। তবে, অবশেষে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জা নিজেই দেশটির শাসন ব্যবস্থাকে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেন এবং সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া:

আয়ুব খান ১৯৫৮ সালে পিপলস পার্টির নেতা ফাতিমা জিন্নাহ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে মিলিটারি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নেন এবং রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জার কাছ থেকে শাসন গ্রহণ করেন। আয়ুব খান সামরিক সরকারের অধীনে পাকিস্তানের একটি নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

২. আয়ুব খানের শাসন বৈশিষ্ট্য

আয়ুব খানের শাসন ছিল এক ধরনের সামরিক শাসন, যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে একটি বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাঁর শাসনব্যবস্থার কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

ক) সামরিক শাসন (Military Rule):

আয়ুব খানের শাসন ছিল সামরিক শাসন, যেখানে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারের প্রতি সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি গণতন্ত্রকে সীমিত করে, সামরিক বাহিনীর শক্তিকে আরও শক্তিশালী করেন। শাসক হিসেবে তিনি কখনো জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বড় সিদ্ধান্ত নিতে সংকোচ বোধ করতেন না এবং সামরিক বাহিনীকে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা দিতে থাকেন।

খ) সংবিধান পরিবর্তন (Constitutional Changes):

১৯৬২ সালে আয়ুব খান পাকিস্তানে একটি নতুন সংবিধান চালু করেন। নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ক্ষমতা অনেকটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। এই সংবিধান পাকিস্তানকে একটি প্রেসিডেন্ট শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অনেক ব্যাপক ছিল। এই সংবিধান পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোকে এককেন্দ্রিক ও শক্তিশালী করে তুলে।

গ) একদলীয় শাসনব্যবস্থা (One-Party Rule):

আয়ুব খানের শাসনকালে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম অনেকটা সীমিত হয়ে পড়েছিল। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগ (প্রথমত) নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, যা শাসক দলেরূপে কাজ করত এবং রাষ্ট্রপতির অধীনে ছিল। এর মাধ্যমে তিনি কার্যত একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে শাসক দলকে আরও শক্তিশালী করেন।

ঘ) অর্থনৈতিক সংস্কার (Economic Reforms):

আয়ুব খান তার শাসনকালে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তিনি শিল্প ও ব্যবসায়িক খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে চেষ্টা করেন। তিনি পাকিস্তানে কৃষি, শিল্প, এবং বাণিজ্যের মধ্যে আধুনিকীকরণের জন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তার নেতৃত্বে "গ্রিন রেভোলিউশন" শুরু হয়, যা পাকিস্তানের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এই উন্নতি জনগণের মধ্যে সামগ্রিকভাবে সমানভাবে বিতরণ হয়নি, ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যায়।

ঙ) উন্নয়নমূলক কর্মসূচি (Development Programs):

আয়ুব খান তাঁর শাসনামলে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেন, যেমন পানি সরবরাহ, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। তিনি পাকিস্তানের শিল্পক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ দেন, যা তার শাসনকে কিছুটা সফল করতে সহায়তা করেছিল।

চ) গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে দুর্বলতা (Weakening of Democratic Rights):

আয়ুব খানের শাসনে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত ছিল। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও অনেকটাই ক্ষুন্ন হয় এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালানো হয়। বিরোধী দলগুলোর প্রতি তার সহিংস মনোভাব এবং তাদের বিক্ষোভ দমন করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়।

ছ) সামাজিক পরিবর্তন (Social Changes):

আয়ুব খান নারী শিক্ষায় কিছু অগ্রগতি আনেন এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু আইন প্রণয়ন করেন, তবে তার শাসনকালে নারী বা সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু উন্নতি হলেও, তা ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েনি।

৩. আয়ুব খানের শাসনের অবসান

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর, যদিও পাকিস্তান কিছুটা জয়ী হয়েছিল, তবে জাতীয় পর্যায়ে নানা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের পর আয়ুব খানের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমে যায়। তার শাসনব্যবস্থার মধ্যে বিরোধিতা বাড়তে থাকে, এবং জনগণ তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। এর ফলে ১৯৬৯ সালে আয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

উপসংহার

আয়ুব খানের শাসন পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর ক্ষমতা দখল এবং শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল বেশ বিতর্কিত। সামরিক শাসনের মাধ্যমে পাকিস্তানে আধুনিকীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নতির চেষ্টা হলেও, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। আয়ুব খানের শাসন পাকিস্তানে শাসনব্যবস্থার নতুন কৌশল এবং সামরিক ক্ষমতার উত্থান ঘটালেও তার শাসনের সমাপ্তি ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গণপ্রতিরোধের কারণে।


Q2. শামরিক শাসন" *

"শামরিক শাসন" একটি রাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে সামরিক বাহিনী সরাসরি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে এবং দেশ শাসন করে। এটি সাধারণত গণতান্ত্রিক বা বেসামরিক শাসনের বিপরীতে আসে এবং জরুরি পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের সময় কার্যকর করা হয়। শামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য, কারণ এবং প্রভাব সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।

শামরিক শাসনের সংজ্ঞা

শামরিক শাসন হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দেশের প্রশাসন পরিচালনা করে। সাধারণত এটি সংবিধান স্থগিত করে অথবা সীমিত করে। অনেক সময় শামরিক শাসন মেয়াদ নির্ধারণ ছাড়াই পরিচালিত হয়।

শামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার কারণসমূহ

১. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা:
যখন দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে এবং বেসামরিক সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।

২. অর্থনৈতিক সংকট:
দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দা বা আর্থিক দুরবস্থা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করলে শামরিক হস্তক্ষেপ দেখা দিতে পারে।

৩. জাতীয় নিরাপত্তা:
বিদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ বা বিদেশি হুমকির মতো পরিস্থিতিতে সামরিক শাসন কার্যকর হতে পারে।

৪. নেতৃত্বের অভাব:
দুর্নীতি বা অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে জনগণের সমর্থন হারালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে।

শামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য

১. সর্বোচ্চ ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
২. সংবিধান স্থগিত বা বাতিল হতে পারে।
৩. বিচার ব্যবস্থা সামরিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৪. মিডিয়া ও বাকস্বাধীনতার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
৫. বেসামরিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা সীমিত বা নিষিদ্ধ করা হয়।

শামরিক শাসনের প্রভাব

সুবিধা:

১. অস্থিরতা দূর করার জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব।
২. আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর দক্ষতা কার্যকর হতে পারে।
৩. দুর্নীতি প্রতিরোধে সামরিক শাসন কখনো কার্যকর হতে পারে।

অসুবিধা:

১. মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ হয়।
২. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. দীর্ঘমেয়াদে শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. জনমতের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব দেখা যায়।

বাংলাদেশে শামরিক শাসন

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনের একটি অধ্যায় শুরু হয়। এর পরপরই ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসন উল্লেখযোগ্য।

উপসংহার

শামরিক শাসন সাধারণত একটি অস্থায়ী সমাধান হিসেবে দেখা যায়। এটি কিছু সময়ের জন্য স্থিতিশীলতা আনতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি গণতন্ত্র এবং জনগণের স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর। তাই সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই একটি রাষ্ট্রের জন্য সর্বোত্তম পথ।

Q3. শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন ***

শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন, যা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার জন্য সংঘটিত হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ঘোষিত "শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট" এর বিরুদ্ধে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। এটি পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী এবং বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাতিলের সংগ্রাম ছিল।

শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ১৯৫৯

পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য ড. এস. এম. শরিফের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।

  • রিপোর্টে শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামিক আদর্শ এবং পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ প্রচারের ওপর জোর দেওয়া হয়।
  • প্রাথমিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যাওয়ার নীতি প্রণীত হয়।
  • মাতৃভাষার পরিবর্তে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়।

বিরোধিতার কারণ:

  1. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ: উচ্চশিক্ষার জন্য বর্ধিত খরচ আরোপের প্রস্তাব সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষাকে দুর্বোধ্য করে তোলে।
  2. মাতৃভাষার উপেক্ষা: বাংলা ভাষার গুরুত্ব অস্বীকার করে উর্দুকে প্রধান ভাষা হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
  3. সংস্কৃতির ওপর আঘাত: বাঙালির সংস্কৃতি ও জাতিসত্তাকে উপেক্ষা করে ইসলামিক জাতীয়তাবাদের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
  4. শিক্ষার সামরিকীকরণ: শিক্ষাকে সামরিক আদর্শের সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা।

আন্দোলনের সূচনা

১৯৬২ সালের শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়।

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা প্রতিবাদ শুরু করে।
  • ১৯৬২ সালের জুন মাসে প্রতিবাদ তীব্র আকার ধারণ করে।
  • ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়, যা "ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ" নামে পরিচিত।

আন্দোলনের মূল দাবি

১. শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল।
২. বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও প্রশাসনের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা।
৩. উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়তি ফি বাতিল।
৪. শিক্ষার সামরিকীকরণ বন্ধ।
৫. সবার জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।

আন্দোলনের প্রধান ঘটনাবলি

  1. প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ:

    • ঢাকায় ছাত্ররা মিছিল বের করে এবং প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
    • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
  2. পুলিশি দমন-পীড়ন:

    • ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশ ঢাকার মিছিল ও সমাবেশে গুলি চালায়।
    • এতে বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত হন, যা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে।
  3. সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট:

    • ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।

ফলাফল ও তাৎপর্য

  1. শিক্ষানীতি বাতিল:
    তীব্র আন্দোলনের চাপে শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট কার্যত বাতিল হয়ে যায়।

  2. ছাত্রদের শক্তি প্রদর্শন:
    এই আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ তাদের ঐক্য ও শক্তি প্রদর্শন করে।

  3. স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন:
    এই আন্দোলন পাকিস্তান সরকারের শাসন এবং বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি স্থাপন করে।

  4. জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগরণ:
    বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও গভীর করে।

উপসংহার

১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। এটি শুধু একটি শিক্ষানীতি বাতিলের জন্য ছিল না; এটি বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার আন্দোলন হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে এ আন্দোলন বাঙালির স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগায়।


Q4. ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন *

১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে সাধারণ মানুষ এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এই আন্দোলন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতি এবং দাঙ্গার পেছনে তাদের ভূমিকার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।

প্রেক্ষাপট

১. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা:

১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

  • কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদ থেকে কথিতভাবে মোহাম্মদ (সা.)-এর চুলের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়।
  • এই গুজবকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু হয়।
  • এই সহিংসতা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে।

২. পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা:

পাকিস্তান সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে ব্যর্থ হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা এই দাঙ্গাকে উসকে দিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

৩. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া:

বাঙালি জনগণ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং এ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করে।

আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য

১. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করা।
২. হিন্দু-মুসলিম ঐক্য রক্ষা করা।
৩. পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক উসকানি এবং বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ করা।
৪. ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

আন্দোলনের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ

১. ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দল:
প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। বিশেষ করে বামপন্থি দলগুলো এবং আওয়ামী লীগ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

  1. সাধারণ জনগণের ভূমিকা:
    সাধারণ মানুষ দাঙ্গার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে কাজ করে।

  2. সংস্কৃতিকর্মীদের অবদান:
    কবি, লেখক, ও সংস্কৃতিকর্মীরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সৃজনশীল মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন।

আন্দোলনের পদ্ধতি ও কৌশল

১. মিছিল ও সমাবেশ:
বিভিন্ন শহরে মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়।

  1. সংহতির প্রচার:
    হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিতে প্রচারপত্র, পোস্টার এবং সভার আয়োজন করা হয়।

  2. শান্তি কমিটি গঠন:
    সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিরসনে বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি গঠিত হয়।

ফলাফল ও তাৎপর্য

১. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা:

এই আন্দোলনের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসে এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়।

২. পাকিস্তানের বিভাজন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত:

পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক নীতি এবং দাঙ্গা উসকে দেওয়ার ঘটনাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে উদ্বুদ্ধ করে।

৩. রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি:

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণের ঐক্য পাকিস্তান সরকারের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।

৪. মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি:

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য বাঙালির লড়াই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

উপসংহার

১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বাঙালির ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধের প্রমাণ দেয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিক মূল্যবোধ আরও সুদৃঢ় হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

Q5. জাতীয়তাবাদ কি? ৬ দফার পটভূমি **

জাতীয়তাবাদ কি?

জাতীয়তাবাদ (Nationalism) হলো একটি রাজনৈতিক ধারণা এবং সামাজিক আন্দোলন, যা একটি জাতির মধ্যে জাতীয় পরিচিতি, ঐক্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে। এটি একটি জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং তার নিজস্ব রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জাতীয়তাবাদ একটি জাতির জনগণকে একত্রিত করে এবং তাদের একটি বিশেষ ভূখণ্ড, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার অনুভূতি দেয়।

জাতীয়তাবাদ একটি দেশ বা জাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রেরণা জোগায়। এটি একটি জাতীয় দল বা জাতির জন্য তাদের নিজস্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং বাইরের শক্তির থেকে নিজেদের স্বাধীনতার দাবিকে শক্তিশালী করে।

৬ দফা আন্দোলনের পটভূমি:

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ৬ দফা প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন। এই ৬ দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এই আন্দোলনের পটভূমি ছিল পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) প্রতি অবিচার এবং বৈষম্য।

৬ দফার প্রস্তাবনা:

১. পাকিস্তান সরকারের শাসনব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ চাইছিল যে, তারা তাদের নিজস্ব সরকারের মাধ্যমে শাসিত হোক। ৬ দফায় শাসনব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও স্বার্থের প্রতি অবহেলা না করে।

  1. আর্থিক এবং অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষোভ প্রকাশ করে যে, তারা অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হচ্ছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ (বর্তমানে পাকিস্তান) পূর্ব পাকিস্তান থেকে অধিকাংশ অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকত। ৬ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবির পাশাপাশি তাদের নিজস্ব শিল্প এবং কৃষি ক্ষেত্রের উন্নতির দাবি করা হয়েছিল।

  2. পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব: পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত কম ছিল, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ৬ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারী জনগণের সংখ্যা অনুযায়ী জাতীয় সংসদে সমান প্রতিনিধিত্ব দাবি করা হয়।

  3. বিদেশনীতি, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগের বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ: ৬ দফায় প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান তার নিজস্ব বিদেশনীতি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে। এতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর পূর্ব পাকিস্তানের ভিন্ন মতামত প্রকাশ পায়।

  4. মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির স্বীকৃতি: পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা এবং বাংলাভাষী জনগণের প্রতি অসম্মান দেখিয়েছিল। ৬ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সাংস্কৃতিক অধিকার এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করা হয়েছিল।

  5. কেন্দ্রীয় সরকার এবং সামরিক বাহিনীর দমনপীড়ন বন্ধ করা: ৬ দফায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দমন-পীড়ন এবং সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং প্রশাসন বিভিন্ন সময় জনগণের ওপর নিপীড়ন চালাত, যা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল।

৬ দফার আন্দোলনের পটভূমি:

৬ দফার পটভূমি ছিল পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর অবিচার ও বৈষম্য, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক অধিকারকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের শোষণ করছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে কখনোই যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে এই ৬ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জন করা। ৬ দফার মাধ্যমে শেখ মুজিব পাকিস্তান সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত গঠন করতে চেয়েছিলেন। এই আন্দোলন, পরবর্তীকালে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়।

৬ দফার আন্দোলনের প্রভাব:

৬ দফা আন্দোলন পাকিস্তানে এবং বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) একটি বিপ্লবী মুহূর্ত তৈরি করেছিল। এটি পাকিস্তান সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ এবং উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করে, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়। ৬ দফার আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পাথেয় তৈরি হয়।

উপসংহার: ৬ দফা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি বড় ধাপ। এটি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ গণআন্দোলন সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।


Q6. ৬ দফা দাবি ও তার তাৎপর্য ***

৬ দফা দাবি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এই দাবিগুলো উপস্থাপন করেন। ৬ দফার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করা এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এই দাবিগুলো পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি রচনা করে।

৬ দফা দাবির পটভূমি

১. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য:

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) বৈষম্যের শিকার হতে থাকে।

  • পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বঞ্চিত ছিল।
  • পূর্ব পাকিস্তান থেকে আয়কৃত রাজস্বের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো।

২. কেন্দ্রীয় শাসনের আধিপত্য:

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রেখেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও মতামত উপেক্ষা করা হয়।

৩. বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা:

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবোধের উত্থান ঘটে।

৪. সামরিক শাসন:

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আরও নিপীড়নের শিকার হয়।

৬ দফা দাবির মূল বিষয়বস্তু

৬ দফা দাবিতে বঙ্গবন্ধু মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। দাবিগুলো ছিল:

  1. সংবিধানে প্রকৃত ফেডারেল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা:
    পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, এবং প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব ক্ষমতা থাকবে।

  2. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও স্বায়ত্তশাসন:
    প্রতিটি প্রদেশ নিজস্ব রাজস্ব আদায় ও ব্যবহারের অধিকার পাবে।

  3. আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থা:
    পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব মুদ্রানীতি থাকবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা মুদ্রা চালু করবে।

  4. বৈদেশিক বাণিজ্য ও আয় নিয়ন্ত্রণ:
    প্রাদেশিক সরকার নিজস্ব বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে এবং আয় উপার্জন করবে।

  5. আন্তঃপ্রদেশ লেনদেন:
    আন্তঃপ্রদেশ লেনদেন নির্ধারণ হবে পৃথক চুক্তির মাধ্যমে।

  6. সামরিক বিষয়:
    প্রতিটি প্রদেশ নিজস্ব মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে।

৬ দফার তাৎপর্য

১. বাঙালির জাতীয়তাবোধের উত্থান:

৬ দফা দাবি প্রথমবারের মতো বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রদান করে।

২. পাকিস্তানি শাসকদের আতঙ্ক:

৬ দফা দাবি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছে দেশ ভাঙার নীলনকশা বলে মনে হয়।

৩. গণ-আন্দোলনের সূচনা:

৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৬৬ সালের পর থেকে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গণ-আন্দোলন শুরু হয়।

৪. স্বাধীনতার ভিত্তি:

৬ দফা দাবি ছিল মূলত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধাপ। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলনীতি হয়ে ওঠে।

৫. বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:

৬ দফা দাবির মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

৬ দফা দাবির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

  • পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান ৬ দফাকে "দেশবিভাগের পরিকল্পনা" হিসেবে আখ্যা দেন।
  • শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়।
  • ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।

৬ দফার পরিণতি ও গুরুত্ব

  1. স্বাধীনতার আন্দোলন ত্বরান্বিত করা:
    ৬ দফার দাবির প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছিল। এটি বাঙালির স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে তোলে।

  2. ১৯৭০ সালের নির্বাচন:
    ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে।

  3. মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা:
    ৬ দফা দাবি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শ ও নীতিতে রূপান্তরিত হয়।

উপসংহার

৬ দফা দাবি ছিল বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির দাবির একটি সুসংহত প্রস্তাব। এটি শুধু পাকিস্তানের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল না, বরং এটি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকেও ইঙ্গিত করেছিল।


Q7. আগরতলা মামলা: কারণ ও ফলাফল **

আগরতলা মামলা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনা। এটি ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্বস্তি মোকাবিলা করছিল। আগরতলা মামলা মূলত ছিল পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) স্বাধীনতা আন্দোলন ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে একটি দমন-পীড়নমূলক পদক্ষেপ।

আগরতলা মামলার কারণ:

১. পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা: পাকিস্তান সরকার, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমানে পাকিস্তান) থেকে আসা শাসকরা, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি অবিচার ও বৈষম্য প্রদর্শন করছিল। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।

  1. ৬ দফা আন্দোলন: ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন, যার মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এসব দাবির বিরুদ্ধে ছিল এবং মনে করেছিল যে, এই দাবিগুলি পাকিস্তানের সংহতি এবং সার্বভৌমত্বের পক্ষে হুমকি।

  2. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অসন্তোষ: ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারকে মনে হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠছে এবং এটি পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রতি এক বড় আঘাত। তারা ভয় পেতে শুরু করেছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোগীরা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে পাকিস্তান সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল।

  3. পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ: ৬ দফার আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন দাবি করতে শুরু করেছিল। পাকিস্তান সরকার এই জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।

আগরতলা মামলার ঘটনা:

১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা মূলত একটি ষড়যন্ত্র মামলা ছিল, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তারা পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) বিচ্ছিন্নতা ঘটানোর জন্য একটি ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

পাকিস্তান সরকার দাবি করেছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোগীরা পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো কিছু নেতাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

আগরতলা মামলা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনকে দমন করার একটি পদক্ষেপ ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলার মাধ্যমে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে নিঃশব্দ করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

আগরতলা মামলার ফলাফল:

১. শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: আগরতলা মামলার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মানুষ বুঝতে পারে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা আসলে পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতার প্রতিফলন। এতে শেখ মুজিবুর রহমান "মুক্তির নায়ক" হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

  1. আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধি: আগরতলা মামলার কারণে আওয়ামী লীগ আরও শক্তিশালী হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) তাদের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত হয়ে ওঠে। জনগণ মনে করেছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দল পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। এই ঘটনাটি আওয়ামী লীগের সমর্থন বাড়িয়ে দেয়।

  2. পাকিস্তান সরকারের অকার্যকর দমননীতি: পাকিস্তান সরকারের আগরতলা মামলায় ব্যবহৃত দমননীতি প্রত্যাশিত ফলাফল দিতে পারেনি। তারা আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল, কিন্তু এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি বিরোধিতা আরও তীব্র হয়। এটি পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরে।

  3. বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন মাত্রা: আগরতলা মামলা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে একটি শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং নেতা-শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন থেকে মুক্তি লাভের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।

  4. পাকিস্তানে বিভাজন বৃদ্ধি: আগরতলা মামলার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের মধ্যে গভীর বিভাজন সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপগুলি পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।

উপসংহার:

আগরতলা মামলা ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি দমন-পীড়নমূলক পদক্ষেপ, যার লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের আন্দোলন দমন করা। তবে এই মামলার ফলস্বরূপ, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের মধ্যে পাকিস্তান সরকারের প্রতি অসন্তোষ আরও বাড়ে। এটি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে পরিণত হয়।


Q8. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: পটভূমি ও বিস্তারিত আলোচনা ***

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) জনগণের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রকাশ ছিল। পাকিস্তান সরকারের দমনমূলক শাসন, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের প্রতি অবিচার ও বৈষম্য, এর পটভূমিতে এই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।

গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি:

১. পাকিস্তান সরকারের অবিচার ও বৈষম্য: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণ পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমানে পাকিস্তান) শাসকদের দ্বারা অবিচারের শিকার হয়ে আসছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একাধিক বৈষম্য ছিল, যা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছিল।

  1. আগরতলা মামলা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার: ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য আগরতলা মামলা চালায়, যার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাদের দমন করার চেষ্টা করেছিল। তবে, এই মামলার পর শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জনগণের সহানুভূতি বেড়ে যায় এবং তাকে মুক্তির দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে ওঠে।

  2. শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে জনগণের উত্তেজনা: শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের পর, পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণ তাঁর মুক্তির দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনে শামিল হয়। এই আন্দোলনে ছাত্র-যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করতে থাকে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে সারা পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও হরতাল শুরু হয়।

  3. ৬ দফা আন্দোলনের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম: শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা উজ্জীবিত করেছিল। ৬ দফার দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, যা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ছিল। এটি একটি বৃহৎ জনগণ আন্দোলনের রূপ নেয়, যা পাকিস্তান সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান:

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের একটি সফল সংগ্রাম, যা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পরিণত হয়। এই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

গণঅভ্যুত্থানের প্রধান ঘটনা:

  1. শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি:
    শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। জনগণের প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের ফলে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তার মুক্তি আন্দোলনকে আরও তীব্র এবং জনপ্রিয় করে তোলে।

  2. গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্র আন্দোলন:
    ছাত্র সংগঠনগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই আন্দোলনে। ছাত্ররা সর্বপ্রথম হরতাল, বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদে অংশ নেয়। তারা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে চরম আন্দোলন গড়ে তোলে, যার ফলে পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতার শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়।

  3. প্রধানমন্ত্রী আইয়ুব খান ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ:
    পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান সরকার চাপের মুখে পড়েন। তিনি শুরুতে কঠোর দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে ওঠে। জনগণের আন্দোলন এবং ছাত্রদের প্রতিবাদে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

  4. বিভিন্ন আন্দোলনের একীভূত হওয়া:
    পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য সংগঠনের সমর্থনে গণঅভ্যুত্থান জোরালো হয়ে ওঠে।

গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল:

  1. ১. শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:
  2. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি প্রদান এবং তার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। জনগণের শক্তিশালী আন্দোলনের কারণে আইয়ুব খান সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়, যা পরবর্তীতে তাকে বাংলাদেশে স্বাধীনতার নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

  1. আইয়ুব খান সরকারের পতন:
    গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তান সরকারের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়। আইয়ুব খান সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায়, এবং রাজনৈতিক সংকট আরো গভীর হয়। এই আন্দোলন ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে আইয়ুব খান সরকারের পতনের সূচনা ঘটায়, এবং ১৯৭১ সালের দিকে পাকিস্তান সরকারের শাসন আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

  2. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে অগ্রসর হওয়া:
    গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম তীব্র হয়। এটি বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে একটি শক্তিশালী পটভূমি তৈরি করে।

উপসংহার:

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তান সরকারের শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। এটি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে এক জাতিগত সংগ্রাম হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিণত হয়। গণঅভ্যুত্থান, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, পাকিস্তান সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করে, যা স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।


Q9. ১১  দফা আন্দোলন এবং এর ফলাফল ***

১১ দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি মূলত পাকিস্তানের সামরিক শাসন ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর গণআন্দোলন ছিল। ১১ দফা দাবি ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় উত্থাপিত হয় এবং এটি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিশেষ গুরুত্ব পায়।

১১ দফা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ শোষণ করত এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখত।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে প্রেরণা জোগায়। তবে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও এর পরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় ছাত্রসমাজ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে।

১১ দফা দাবি

১১ দফা মূলত ৬ দফার সম্প্রসারিত রূপ। এটি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের দাবি যুক্ত করে একটি সামগ্রিক রূপ দেয়। দাবিগুলো ছিল:

  1. সংবিধান সংস্কার: গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন।
  2. বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ: সামরিক আইনের অবসান এবং বিনা বিচারে হত্যার সমাপ্তি।
  3. আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন: পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।
  4. অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ: পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ এবং ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
  5. বৈদেশিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ: পূর্ব পাকিস্তানের পণ্য রপ্তানির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
  6. শ্রমিক অধিকার: শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও অধিকার নিশ্চিত করা।
  7. শিক্ষা সংস্কার: গণমুখী ও বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা।
  8. জমিদারি প্রথার অবসান: কৃষকদের অধিকার রক্ষা এবং জমির উপর তাদের মালিকানা নিশ্চিত করা।
  9. সামরিক খরচ হ্রাস: সামরিক বাজেট কমিয়ে জনগণের কল্যাণে ব্যয় বৃদ্ধি।
  10. বাকস্বাধীনতা: গণমাধ্যম ও মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
  11. ধর্মনিরপেক্ষতা: ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা।

১১ দফা আন্দোলনের প্রধান চরিত্র

  • নেতৃত্ব: এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রসমাজ। বিশেষত, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠন।
  • সর্বস্তরের অংশগ্রহণ: শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
  • ব্যাপক সমর্থন: পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে আন্দোলন ব্যাপক সমর্থন পায় এবং তা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

ফলাফল ও গুরুত্ব

১১ দফা আন্দোলনের ফলস্বরূপ:

  1. আইয়ুব খানের পতন: ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দেন।
  2. বঙ্গবন্ধুর মুক্তি: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি পান।
  3. আন্দোলনের অগ্রগতি: ১১ দফা আন্দোলন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নতুন গতি এনে দেয়।
  4. স্বাধীনতার প্রেরণা: এটি পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি স্থাপন করে।

উপসংহার

১১ দফা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে জোরালো করে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করে। এটি বাঙালির রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নতুন দিকনির্দেশনা দেয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


Q10. 1970 সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ***

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দীর্ঘদিনের অধিকারহরণের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।

প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে।

  • পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকৃত ছিল।
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার করে।
  • ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
  • ইয়াহিয়া খান ল্যামার কমিশনের সুপারিশে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য

  1. স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন।
  2. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
  3. পাকিস্তানের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে।
  4. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
  5. নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনের ফলাফল

  1. আওয়ামী লীগের বিজয়:

    • পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়।
    • জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে (৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি)।
  2. পশ্চিম পাকিস্তানে পরাজয়:

    • পশ্চিম পাকিস্তানের বড় দল পিপলস পার্টি (জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে) ৮১টি আসনে বিজয়ী হয়।
  3. গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট:

    • আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবিকে সমর্থন করেছে।

গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১. গণতান্ত্রিক বিজয়:

১৯৭০ সালের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ ছিল। এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে দৃঢ় করে।

২. সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকার:

আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠনের ন্যায্য অধিকার অর্জন করে। এটি প্রমাণ করে যে পাকিস্তানের জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে।

৩. পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র:

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের বিজয়কে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো একযোগে ষড়যন্ত্র শুরু করেন, যা পরবর্তীতে সংঘাত সৃষ্টি করে।

৪. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট:

পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমসি এবং বঙ্গবন্ধুর দাবি উপেক্ষা করার ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়।

৫. রাজনৈতিক সচেতনতা:

১৯৭০ সালের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং জাতীয় ঐক্য সুসংহত করে।

ফলাফল ও পরিণতি

  1. ক্ষমতা হস্তান্তরের অস্বীকৃতি:
    ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান এবং পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করেন।

  2. মুক্তিযুদ্ধ:
    ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর 'অপারেশন সার্চলাইট' বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে।

  3. বাংলাদেশের স্বাধীনতা:
    ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

উপসংহার

১৯৭০ সালের নির্বাচন কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না; এটি বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিজয় ছিল। এই নির্বাচন স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে এবং বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা সুদৃঢ় করেছে।


Q11. অসহযোগ আন্দোলন এবং অপারেশন সার্চলাইট **

অসহযোগ আন্দোলন এবং অপারেশন সার্চলাইট ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ দুটি ঘটনাই পাকিস্তান সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) জনগণের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাতের সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়।

অসহযোগ আন্দোলন (Non-Cooperation Movement)

অসহযোগ আন্দোলন ছিল ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হওয়া একটি বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন, যা পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ছিল। এই আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের জন্য স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবি ছিল।

অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি:

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যক আসন লাভ করে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনে অস্বীকৃতি জানায়। পাকিস্তান সরকার, বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো, পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের স্বায়ত্তশাসন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি বিরোধিতা শুরু করে।

এই পরিস্থিতিতে, শেখ মুজিবুর রহমান "অসহযোগ আন্দোলন" শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পাকিস্তান সরকারের শাসনের সাথে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করতে বলেন।

অসহযোগ আন্দোলনের মূল দাবি:

  1. পাকিস্তান সরকারের প্রতি সহযোগিতা বন্ধ: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তান সরকারের যে কোনো রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্তের প্রতি সহযোগিতা বন্ধ রাখে।
  2. স্বায়ত্তশাসন এবং অধিকার: শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
  3. শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ: আন্দোলনটি ছিল মূলত অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ। জনগণ বিক্ষোভ, ধর্মঘট, ও প্রতিবাদে অংশ নেয়।

অপারেশন সার্চলাইট (Operation Searchlight)

অপারেশন সার্চলাইট ছিল ২৫ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) চালানো একটি ব্যাপক দমন-পীড়ন অভিযান। এটি ছিল পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চলমান অসহযোগ আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার জন্য পরিকল্পিত একটি সামরিক অপারেশন।

অপারেশন সার্চলাইটের পটভূমি:

অসহযোগ আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ের পর পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিল এবং একনায়ক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এর মধ্যে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে দমন করার পরিকল্পনা নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) সামরিক অভিযান চালানোর জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামক দমন-পীড়ন অভিযানের সূচনা করে।

অপারেশন সার্চলাইটের ঘটনা:

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় বিক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ শুরু করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেফতার করা, স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করা, এবং জনগণের প্রতিবাদ বন্ধ করা।

  • ঢাকার আক্রমণ: পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় নৃশংস আক্রমণ শুরু করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রবেশ করে।
  • নাগরিক হত্যা: ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, এবং হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়।
  • অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট: পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাড়ি-বাড়ি আগুন ধরিয়ে দেয় এবং লুটপাট চালায়।
  • ধর্ষণ ও নির্যাতন: হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়, এবং বিপুল সংখ্যক নির্যাতিত হয়।

অপারেশন সার্চলাইটের ফলাফল:

  • বাঙালি জাতির প্রতিবাদ: অপারেশন সার্চলাইটের পর, পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ব্যাপক প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ শুরু হয়। এতে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে ওঠে।
  • বৃহৎ জনগণের হতাহত: অপারেশন সার্চলাইটের ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রচুর বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।
  • বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা: অপারেশন সার্চলাইটের পর বাঙালি জনগণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এর পর, ভারতীয় সেনাবাহিনীও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

উপসংহার:

অসহযোগ আন্দোলন এবং অপারেশন সার্চলাইট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অসহযোগ আন্দোলন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন দাবি করার একটি শক্তিশালী আন্দোলন, যা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জনজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এর পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট চালানো হয়, যা এক বিশাল গণহত্যার ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। তবে, অপারেশন সার্চলাইটের পর বাংলাদেশের জনগণ সংগ্রাম শুরু করে, এবং তাদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন হয়।


Q12. মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র *

মুজিবনগর সরকার এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। এই দুটি ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক, যা পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির সংগ্রামকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা প্রদান করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সুষ্ঠু নেতৃত্ব নিশ্চিত করে।

মুজিবনগর সরকার গঠন:

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর, শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করার পাশাপাশি পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের চেষ্টা চালায়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) স্বাধীনতা সংগ্রাম আরো তীব্র হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

এ পরিস্থিতিতে মুজিবনগর সরকার গঠন হয়, যা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে কাজ করে।

মুজিবনগর সরকারের গঠন:

  1. গঠন: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুজিবনগর শহরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারকে মুজিবনগর সরকার বলা হয়, যা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে কাজ করেছিল।

  2. নেতৃত্ব: মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদকে নির্বাচিত করা হয়, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। এর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে ছিলেন:

    • শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানে বন্দী থাকা সত্ত্বেও সরকারে একনিষ্ঠ নেতা হিসেবে ছিলেন)
    • মওলানা ভাসানী
    • কাজী শহীদুল্লাহ
    • ইসহাক চৌধুরী
    • আলতাফ মাহমুদ
  3. মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ: মুজিবনগর সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান, আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বজনমত সৃষ্টি করা। সরকার ভারতের সাহায্য এবং সমর্থন লাভ করার জন্যও কাজ করে।

স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র:

স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্কটময় মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঘোষিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা ২৬ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে পাঠ করা হয়েছিল। যদিও শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করে, তার স্বাধীনতার ঘোষণা পুরো জাতির জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বৈধতা তৈরি করে।

স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র:

শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ছিল পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকার রক্ষার একটি ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় আক্রমণ শুরু করলে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং ২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।

স্বাধীনতার ঘোষণার মূল বিষয়:

  1. স্বাধীনতার ঘোষণা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর আক্রমণের পরে বলেন, "আমরা আজ স্বাধীন, আমরা আজ মুক্ত।"

  2. বাংলাদেশের স্বাধীনতা: বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জনগণকে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।

  3. গণতান্ত্রিক অধিকার: তিনি জনগণকে জানিয়ে দেন যে, পাকিস্তানের শাসকরা তাদের অধিকার হরণ করেছে এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।


মুজিবনগর সরকার ও স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের গুরুত্ব:

  1. আন্তর্জাতিক সমর্থন: মুজিবনগর সরকার এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র আন্তর্জাতিক সমাজে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানে সহায়ক হয়।

  2. মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা: মুজিবনগর সরকারের প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বৈধতা দেয় এবং পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে প্রতিষ্ঠিত করে।

  3. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম: স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং তা ৯ মাস ধরে চলতে থাকে।

  4. ভারতের সহায়তা: মুজিবনগর সরকার ভারত সরকারের সহযোগিতা লাভ করে এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যা স্বাধীনতার অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার:

মুজিবনগর সরকার গঠন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দুটি ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক বৈধতা ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে একে একে অগ্রসর হতে সহায়তা করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় এবং এ দুটি ঘটনা স্বাধীনতার সূচনা হিসেবে ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকে।


Q13. মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান **

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জাতিগত সংগ্রাম, যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুধু সেনাবাহিনী বা রাজনৈতিক নেতাদের সংগ্রাম ছিল না, এটি ছিল সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সংগ্রাম। যারা নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে রেখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিল, তাদের অবদান কোনোদিনও ভুলে যাওয়ার মতো নয়।

সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অবদান:

১. প্রতিরোধ ও বিক্ষোভ:

  • পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর, যেখানে পাকিস্তান সেনারা ঢাকা ও অন্যান্য শহরে গণহত্যা চালায়, সেখানে শহরের সাধারণ জনগণ জীবন রক্ষার্থে পালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নেয়।
  • ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষকসহ সব শ্রেণীর মানুষ যেখানেই সম্ভব ছিল, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। প্রতিটি শহরে সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, রাস্তায় প্রতিবাদ জানায় এবং সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।

২. গেরিলা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ত্রাণদানে অংশগ্রহণ:

  • মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অনেক সাধারণ মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় সাধারণ জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে, তাদের আশ্রয় দেয়, অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সামরিক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেয়।
  • ত্রাণ কার্যক্রম: সাধারণ মানুষ যুদ্ধের অসহায় শরণার্থী ও আহতদের সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন ত্রাণ সংগ্রহ, বিতরণ এবং শরণার্থী শিবিরে সহায়তার কাজ করেছে।

৩. মহিলাদের অবদান:

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের অবদান ছিল একেবারে গুরুত্বপূর্ণ। তারা শুধু প্রথাগতভাবে যুদ্ধের অংশ নেয়নি, বরং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা, রেডক্রসের মতো ত্রাণ সংস্থাগুলিতে কাজ করেছে, এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধজীবী হিসেবে আত্মত্যাগও করেছে।
  • মহিলারা তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে, পাক সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় এবং সহায়তা প্রদান করে।

৪. শহীদদের অবদান:

  • মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের ভূমিকা শুধু সক্রিয় অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ ছিল না, অনেকেই শহীদ হয়েছেন। নিরীহ সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়ে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের স্বাধীনতার জন্য।
  • ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়। তাদের অবদান ছিল অনুপ্রেরণার, কারণ তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন দিল।

৫. পলাতক জনগণের অবদান:

  • মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধারণ জনগণ শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও অসীম সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সাথে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বহু গ্রামবাসী পাক সেনাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে পলাতক অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করেছিল।
  • এইসব পলাতকরা বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা দিত, যেমন: তথ্য সংগ্রহ, গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা, এবং ত্রাণ কার্যক্রম।

গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ:

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র যুদ্ধের অংশগ্রহণই করেনি, তারা পাকিস্তান সরকারের সাংস্কৃতিক দমন-পীড়ন এবং জাতীয় ভাষা আন্দোলন এর বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

  • ভাষা আন্দোলন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং তার পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বড় ভূমিকা। তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ছিল বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধ গঠনে অন্যতম অনুপ্রেরণা।
  • কবিতা, গান ও নাটক: মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ জনগণ সাহসী কবিতা, গান এবং নাটকের মাধ্যমে দেশপ্রেম ও সংগ্রামের জোয়ার তৈরি করেছিল। সংগীত এবং কবিতার মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল।

উপসংহার:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ শুধু সৈন্যবাহিনীর নয়, এটি সামাজিক সংগ্রাম, গণ-আন্দোলন, এবং বাঙালির স্বাধীনতা প্রাপ্তির সংগ্রাম ছিল। সাধারণ মানুষ, তাদের জীবনের সর্বোচ্চ মূল্যবান সম্পদ, অর্থাৎ প্রাণ, দিয়ে সংগ্রাম করে পাকিস্তানি শাসনকে পরাজিত করেছে। তাদের অবদান কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়, এবং তারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।


Q14. মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও বিদেশী দেশের অবদান **

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি মুক্তির সংগ্রাম, যেখানে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানী শাসন থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ চালিয়েছে। এই সংগ্রামের পথে ভারত এবং অন্যান্য বিদেশী দেশ বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদান করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল।

ভারতের অবদান:

ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ভারত ছিল মূল সমর্থক দেশ। ভারতের সহায়তা বিভিন্ন দিক থেকে এসেছে।

১. রাজনৈতিক সহায়তা:

ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাংলাদেশের জনগণের অধিকার এবং স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনে কাজ করেন। তিনি বিশ্ব নেতাদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন।

২. সামরিক সহায়তা:

  • ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে, মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় মাসে, ভারত বাংলাদেশে সামরিক সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় অংশগ্রহণ করে।
  • ভারতের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি বড় আক্রমণ চালায়। ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়।
  • ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম হয়।

৩. শরণার্থী ও ত্রাণ সহায়তা:

  • পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে চলে যায়। ভারত সরকার এই শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা প্রদান করে।
  • এছাড়াও, ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

৪. মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণ:

ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচিত করতে এবং পৃথিবীজুড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবি জানাতে বিশ্ব দরবারে প্রচেষ্টা চালায়। ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য রাখেন এবং পাকিস্তানের সামরিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

বিদেশী দেশের অবদান:

১. যুক্তরাষ্ট্র (USA):

  • মুক্তিযুদ্ধের সময়, যদিও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মিত্র ছিল এবং তাদের অনেক সাহায্য করেছিল, তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানের নৃশংসতা এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।
  • এর ফলে, বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সমর্থন জোগায়। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন দিয়ে যুদ্ধের মাঝে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকলেও, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়।

২. সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR):

  • সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। তারা পাকিস্তানকে সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক এবং সামরিক সমর্থন দেয়।
  • সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন জানায় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতের আক্রমণের সমর্থন করে।
  • তাদের সাহায্য বাংলাদেশের যুদ্ধ সক্ষমতাকে শক্তিশালী করে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তার ভিত্তিতে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে সফলভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়।

৩. যুক্তরাজ্য (UK):

  • যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে, যদিও তারা পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছিল। তবে, স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন প্রদানে মানবাধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে।
  • ভারতীয় এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের চাপের কারণে যুক্তরাজ্যও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।

৪. অন্যান্য দেশ:

  • জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন এবং শুধুমাত্র কিছু রাজনৈতিক দল পাকিস্তান সরকারের নৃশংসতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশী স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে দাঁড়ায়।
  • বেলজিয়াম, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস জাতি সংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।

উপসংহার:

ভারত এবং বিদেশী দেশগুলোর সহায়তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সরাসরি সামরিক সহায়তা ও রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে এত দ্রুত অগ্রসর হতে পারতো না। এছাড়া, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহানুভূতি এবং সমর্থন বাংলাদেশকে পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তির দিকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবদান চিরকাল স্মরণীয় থাকবে, এবং অন্যান্য দেশের মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি সমর্থনও একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছে।


Q15. যৌথ বাহিনী গঠন ও বিজয় ***

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ছিল একটি ঐতিহাসিক সংগ্রাম। এই যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ছিল যৌথ বাহিনী গঠন এবং এর মাধ্যমে অর্জিত বিজয়। যৌথ বাহিনী গঠনের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা একসাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, যা মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করে।

যৌথ বাহিনী গঠনের পটভূমি:

১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অত্যন্ত নৃশংসভাবে বাঙালি জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করে, যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। এই আক্রমণের ফলে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাগণহত্যা শুরু হয়। ২৫ মার্চ রাতে, শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি নতুন দিশায় পরিচালিত হয়।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কারণে বাংলাদেশের কর্মক্ষম সেনাবাহিনী এবং জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। শুরুতে, মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুদ্র দল হিসেবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের সহায়তায় তারা একত্রিত হয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর যোগদান:

ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।

তাদের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সফল হতে পারতো না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৎকালীন জেনারেল মানেকশ এই যৌথ বাহিনীর মূল নেতৃত্ব দেন।

যৌথ বাহিনী গঠন:

১. ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একীভূতকরণ: ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটি সুষ্ঠু সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের সামরিক দক্ষতা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান করে, আর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আঞ্চলিক জানাশোনা ও স্থানীয় সহায়তা দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যক্রমে অংশ নেয়।

২. যৌথ বাহিনীর গঠন: ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা একত্র হয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করে। এ বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা।

৩. যৌথ বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব: যৌথ বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল আরবিন্দ সিং এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের শীর্ষ নেতা জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। তারা যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

যৌথ বাহিনীর বিজয়:

১. পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরাজয়: যৌথ বাহিনী, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে শুরু করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের পরাজয় মেনে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে এবং ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে।

এই আত্মসমর্পণ ছিল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকার কারণে এটি সম্ভব হয়েছিল।

  1. মুক্তিযুদ্ধের বিজয়: যৌথ বাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সরিয়ে দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে এতদিনের শাসন শেষ হয়ে যায়।

যৌথ বাহিনীর বিজয়ের পরবর্তী প্রভাব:

১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা: যৌথ বাহিনীর বিজয়ের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই বিজয় বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, যা চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।

  1. ভারতের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক সমর্থন: ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় এবং সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ায়, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেওয়া হয়।

  2. বিভাগীয় ক্ষয়-ক্ষতি ও পুনর্গঠন: যুদ্ধের পরে, বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর, বাংলাদেশের পুনর্গঠনঅর্থনৈতিক উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারত ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজে সহায়তা দেয়।

উপসংহার:

যৌথ বাহিনী গঠন ও এর মাধ্যমে বিজয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত হওয়া, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতা অর্জন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যৌথ বাহিনী গঠন ও বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সার্থকতা লাভ করে, যা এক নতুন স্বাধীন জাতির জন্ম দেয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Political Sociology ( Salima Jannath Lyra )

Bepari sir - Politics and Governance in South Asia

Basic Computer