Bepari sir - Politics and Governance in South Asia
Q1. How did the British East India company established its authority on the socio political arena in south Asian states?
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা বোঝার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করতে হবে। এই প্রসঙ্গে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল। তারা মসলা, সুতি কাপড়, এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে স্থানীয় রাজা, জমিদার, এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে কোম্পানি তাদের প্রভাব বিস্তার শুরু করে।
২. পলাশীর যুদ্ধ ও সামরিক শক্তি প্রতিষ্ঠা
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কোম্পানি বাংলার নিয়ন্ত্রণ পায়। এর মাধ্যমে তারা প্রচুর সম্পদ এবং কর সংগ্রহের ক্ষমতা অর্জন করে। কোম্পানি তাদের সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য স্থানীয় সেনাবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয় এবং প্রভাবশালী জমিদারদের সমর্থন লাভ করে।
৩. দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা
১৭৬৫ সালে দেওয়ানি অধিকার লাভের মাধ্যমে কোম্পানি বাংলায় প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জন করে। এর ফলে তারা রাজস্ব সংগ্রহের নিয়ন্ত্রণ পায়, কিন্তু স্থানীয় নবাবদের নামমাত্র শাসক হিসেবে রেখে দেয়। এই "দ্বৈত শাসন" কোম্পানিকে প্রশাসনিক খরচ ছাড়াই রাজস্ব আদায়ের সুবিধা দেয়।
৪. রাজনৈতিক কূটনীতি ও স্থানীয় শাসকদের দুর্বল করা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদের মধ্যে কূটনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করে। "Divide and Rule" নীতির মাধ্যমে তারা স্থানীয় শাসকদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত রাখে। উদাহরণস্বরূপ, মাইসোরের টিপু সুলতান এবং মারাঠা শাসকদের সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে কোম্পানি তাদের শক্তি বাড়ায়।
৫. নিয়মনীতি ও প্রশাসনিক সংস্কার
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ আইন এবং শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট এবং পরে ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানি প্রশাসনিক কাঠামোতে আধুনিকতা আনে, যা তাদের শাসনকে দৃঢ় করে তোলে।
৬. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
কোম্পানি শিক্ষার মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং ভাবধারা ছড়িয়ে দেয়। ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে নীতিমালা গ্রহণ করেন, যা ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ প্রভাবকে আরও সুদৃঢ় করে।
৭. অর্থনৈতিক শোষণ ও কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন
কোম্পানি স্থানীয় কৃষি ব্যবস্থাকে বাণিজ্যিক পণ্যের চাষের দিকে নিয়ে যায়, যেমন—নীল, আফিম, এবং কাঁচা পাট। এই প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কোম্পানির উপর নির্ভরতা বেড়ে যায়।
৮. বিদ্রোহ দমন ও কঠোর দমননীতি
বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ হলে কোম্পানি তা দমন করতে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে কোম্পানি দেখিয়ে দেয় যে তারা যেকোনো বিদ্রোহ কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
উপসংহার
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক কার্যক্রমের আড়ালে সামরিক শক্তি, প্রশাসনিক সংস্কার, এবং কূটনৈতিক চতুরতার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি কেবল অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি ভারতীয় সমাজের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।
এভাবে তাদের কার্যক্রম ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে।
Q2. Discuss the impact of British colonial rule on South Asian states
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন দক্ষিণ এশিয়ার রাজ্যগুলিতে গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল, যা সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতির বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করেছিল। এখানে প্রভাবের কিছু মূল ক্ষেত্র রয়েছে:
অর্থনৈতিক প্রভাব
1. অর্থনৈতিক শোষণ: ব্রিটিশরা সুপরিকল্পিতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সম্পদ শোষণ করেছে। তারা তুলা, চা এবং নীলের মতো কাঁচামাল বের করে এবং ব্রিটিশ উৎপাদিত পণ্যের সাথে স্থানীয় বাজারকে প্লাবিত করে একটি বাণিজ্য একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
2. অবকাঠামো উন্নয়ন: যদিও প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সম্পদ আহরণের সুবিধা, ব্রিটিশরা রেল, টেলিগ্রাফ এবং বন্দর সহ অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছিল। এই উন্নয়নগুলির মিশ্র প্রভাব ছিল, সংযোগ বৃদ্ধি করে কিন্তু ঔপনিবেশিক স্বার্থও পরিবেশন করে¹।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
1.শিক্ষা এবং ভাষা: ব্রিটিশরা পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা চালু করেছিল, যা শিক্ষিত অভিজাতদের একটি নতুন শ্রেণি তৈরি করেছিল। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক কাঠামো এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ল্যান্ডস্কেপের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে²।
2. সামাজিক সংস্কার: ব্রিটিশ শাসন কিছু সামাজিক সংস্কারের দিকে পরিচালিত করে, যেমন সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি (বিধবাদের পোড়ানো) এবং বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন প্রবর্তন²। যাইহোক, এই সংস্কারগুলি প্রায়ই সামাজিক কল্যাণের জন্য প্রকৃত উদ্বেগের পরিবর্তে ঔপনিবেশিক স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক প্রভাব
1.প্রশাসনিক পরিবর্তন: ব্রিটিশরা একটি কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যা পূর্বে বিদ্যমান বিভিন্ন এবং বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করে। এর মধ্যে ব্রিটিশ আইনের উপর ভিত্তি করে একটি আইনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
2.জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতা আন্দোলন: ব্রিটিশ শাসনও জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিল। শোষণ ও নিপীড়ন দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্থানের দিকে পরিচালিত করে, যা শেষ পর্যন্ত ভারত, পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পরিণত হয়।
জনসংখ্যাগত এবং পরিবেশগত প্রভাব
1.জনসংখ্যা আন্দোলন: 1947 সালে ভারত বিভক্তির ফলে উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথে ইতিহাসের বৃহত্তম গণ স্থানান্তর ঘটে।
2.পরিবেশগত পরিবর্তন: ঔপনিবেশিক কৃষি নীতি এবং রেলপথ নির্মাণের জন্য বন উজাড় দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত প্রভাব ফেলেছে, যার মধ্যে রয়েছে মাটির অবক্ষয় এবং ভূমি ব্যবহারের ধরণ পরিবর্তন।
এই প্রভাবগুলি দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে রূপ দিয়েছে, একটি জটিল উত্তরাধিকার রেখে গেছে যা আজও এই অঞ্চলকে প্রভাবিত করে চলেছে।
Q3. Discuss the rule of the British Govt in the process of constitutional development in India.
ব্রিটিশ সরকার দক্ষিণ এশিয়ার রাজ্যগুলির, বিশেষ করে ভারতের সাংবিধানিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই প্রক্রিয়াটি একটি কাঠামোগত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একাধিক আইন প্রণয়ন এবং সংস্কার জড়িত। এখানে কিছু মূল মাইলফলক রয়েছে:
প্রারম্ভিক আইন প্রণয়ন আইন
1.নিয়ন্ত্রক আইন 1773: এটি ছিল ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনকে কেন্দ্রীভূত করার প্রথম পদক্ষেপ। এটি ভারতের অন্যান্য ব্রিটিশ অঞ্চলগুলির উপর তত্ত্বাবধায়ক ক্ষমতা সহ বাংলার একজন গভর্নর-জেনারেল প্রতিষ্ঠা করেছিল⁴।
2.পিটস ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অফ 1784: এই আইনটি ব্রিটিশ সরকার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা ভাগ করে নিয়ে একটি দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। এর লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং দুর্নীতির সমাধান করা।
সনদ আইন
1. 1813 সালের চার্টার অ্যাক্ট: এই আইনটি ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছে, শুধুমাত্র চা এবং চীনের সাথে বাণিজ্য ছাড়া। এটি মিশনারিদের ভারতে প্রবেশ করতে এবং শিক্ষার প্রচারের অনুমতি দেয়।
2. 1833 সালের সনদ আইন: এই আইনটি বাংলার গভর্নর-জেনারেলকে ভারতের গভর্নর-জেনারেল বানিয়ে প্রশাসনকে কেন্দ্রীভূত করেছিল। এটি একটি অভিন্ন আইনি ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যও ছিল।
ভারত সরকারের আইন
1.1858 সালের ভারত সরকার আইন: 1857 সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে, এই আইনটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ ক্রাউনের কাছে ভারতের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করে। এটি ভারতে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের সূচনা করে।
2.ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট অফ 1861: এই আইনটি সীমিত ক্ষমতার মধ্যে হলেও, আইন পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব চালু করেছে।
মন্টাগু-চেমসফোর্ড সংস্কার এবং 1919 সালের ভারত সরকার আইন
1.মন্টাগু-চেমসফোর্ড সংস্কার: এই সংস্কারগুলির লক্ষ্য ধীরে ধীরে স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠানগুলি চালু করা। 1919 সালের ভারত সরকার আইন প্রদেশগুলিতে একটি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা রাজতন্ত্র নামে পরিচিত।
2. 1935 সালের ভারত সরকার আইন: এই আইনটি ভারতের জন্য একটি ফেডারেল কাঠামোর প্রস্তাব করেছে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে প্রসারিত করেছে। এটি প্রত্যক্ষ নির্বাচনেরও সূচনা করেছে, শাসনে ভারতীয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে⁴।
স্বাধীনতার দিকে
1.ভারতীয় স্বাধীনতা আইন 1947: এই আইনটি ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন রাজ্য, ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করে। এটি ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি এবং নবগঠিত রাজ্যগুলির জন্য স্ব-শাসনের সূচনা চিহ্নিত করেছে।
এই আইন প্রণয়ন এবং সংস্কার দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিক সাংবিধানিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তারা কেন্দ্রীভূত প্রশাসন, আইনি অভিন্নতা এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণা প্রবর্তন করেছিল, যা ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সাংবিধানিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছিল।
Q4: কংগ্রেস এর প্রতিষ্ঠা ও প্রেক্ষাপট
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের প্রথম ফসল হলো ১৮৮৫ সালে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা। মূলত ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতীয়দের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরার জন্য একটি প্লাটফর্ম বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। ব্রিটিশ ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকেই স্বাধিকার ও স্বাধীনতা লাভ সকল ক্ষেত্রে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি
ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৮৮৫ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশে এবং ভারতীয় জনগণের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। আর সি মজুমদার-এর মতে, “A new era in the political life of India began with the foundation of the Indian National Congress towards the very end of the year 1885,” ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয়দের প্রথম সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (Indian National Congress, 1885)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও শোষণনীতির ফলে ভারতবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শুরু থেকেই ভারতীয় জনগণ ব্রিটিশ নীতির কারণে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছিল। ভারতবর্ষে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন এবং স্বায়ত্তশাসনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগণের সচেতন ভূমিকার কারণে একটি স্থায়ী সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
১৮৭৬ সালে ভারতসভা (Indian Association) নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে যা ব্রিটিশ সরকারের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন (Vernacular Press Act) Arms Act এর বিরোধিতা করে। এর ফলে ব্রিটিশদের সাথে ভারতীয়দের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এদিকে ১৮৮৩ সালে ইলবার্ট বিল পাস হলে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় জনগণের ঘৃণা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয়তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার দমননীতির পাশাপাশি গণঅসন্তোষের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় খুঁজতে একজন ভারতদরদি ইংরেজ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রাক্তন কর্মকর্তা স্যার এলান অক্টোভিয়ান হিউম ১৮৮৩ সালে একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে ভারতীয়দেরকে একটি স্থায়ী সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। এভাবে হিউম-এর উদ্যোগে ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বে শহরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ‘সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ (All India National Congress) নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজী, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ভারতের ধনিক ও ব্রিটিশদের অনুগত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্ররূপে কংগ্রেস বিকশিত হতে থাকে। এভাবে কংগ্রেসের গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী), মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিশেষত স্বরাজ ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিকে আরও বেগবান করে তুলেছিলেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য১৮৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম অধিবেশন বসে বোম্বে শহরে। উক্ত অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন কলকাতার প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কংগ্রেসের চারটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেন।
তবে জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয় জনগণের সুসংগঠিত একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম (Political Platform)। এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভারতীয় জনগণের অভাব- অভিযোগ দূর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা, শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশীদারিত্ব অর্জন এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য আবেদন জানানো। ১৯০৫-১৯০৬ সালের দিকে এসে কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রধানত দুটি দাবিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। সেগুলো হলো-
১. স্বরাজ লাভের দাবি ও
২. পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি।
Q5. পাকিস্তান সৃষ্টির পটভূমি
পাকিস্তান সৃষ্টির পটভূমি
পাকিস্তান সৃষ্টির পটভূমি উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিরোধ এবং ব্রিটিশ শাসনের নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের সৃষ্টি ছিল মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল।
পটভূমির প্রধান কারণসমূহ
১. ধর্মীয় পার্থক্য
- ভারতবর্ষের প্রধান দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠী, হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য ছিল সুস্পষ্ট।
- মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার ভিন্নতার কারণে পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
২. ব্রিটিশ শাসনের বিভাজন নীতি
- ব্রিটিশ শাসকরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ (বিভাজন ও শাসন) নীতি অনুসরণ করে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে আরো খারাপ করে তোলে।
- মুসলমানদের শিক্ষা ও প্রশাসনে অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়।
৩. মুসলিম লীগ গঠনের ভূমিকা
- ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে।
- মুসলিম লীগ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এবং মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. হিন্দু জাতীয়তাবাদ
- কংগ্রেসের হিন্দু প্রভাব এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শ মুসলমানদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে।
- হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মুসলমানরা মনে করত তারা কংগ্রেস শাসিত ভারতে শোষিত হবে।
৫. লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪০
- ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম লীগ ভারতবর্ষে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলে।
- এটি পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।
৬. আর্থ-সামাজিক বৈষম্য
- মুসলমানরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল।
- জমিদারি প্রথা এবং ব্রিটিশ প্রশাসনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ কম থাকায় তাদের মধ্যে শোষণের অনুভূতি বাড়ে।
৭. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
- ১৯২০-১৯৪০ এর দশকে বারবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়।
- এসব দাঙ্গা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তোলে এবং পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে ত্বরান্বিত করে।
৮. ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং স্বাধীনতা আন্দোলন
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা আর উপমহাদেশ শাসন করতে সক্ষম ছিল না।
- ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ স্বাধীনতার দাবি তোলায় ব্রিটিশরা ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির ফলাফল
-
পৃথক রাষ্ট্রের উদ্ভব:
ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে সৃষ্টি হয়। -
গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা:
দেশভাগের সময় ব্যাপক সহিংসতা, হত্যা এবং জনগণের স্থানান্তর ঘটে। -
বাংলাদেশের অভ্যুদয়:
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়।
উপসংহার
পাকিস্তান সৃষ্টির পটভূমি মূলত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব এবং ব্রিটিশ শাসনের বিভাজন নীতির ফল। এটি একটি বৃহৎ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল, যা রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। তবে, দেশভাগের পরিণতিতে সহিংসতা এবং বৈষম্য এক নতুন সংকট সৃষ্টি করে।
Q6. পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দ্বারা ক্ষমতা দখলের কারণ
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দ্বারা ক্ষমতা দখলের কারণ
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল একটি সাধারণ ঘটনা। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী বহুবার ক্ষমতা দখল করেছে। এর পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কারণ কাজ করেছে।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রধান কারণসমূহ
১. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা
- স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারেনি।
- নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার অভাব ছিল সুস্পষ্ট।
- রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দেয়।
২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দলীয় কোন্দল
- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ এবং ক্ষমতার লড়াই দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
- দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা জনগণের মধ্যে সামরিক শাসনের প্রতি সমর্থন বাড়ায়।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক অসমতা
- পাকিস্তানের প্রাথমিক দিনগুলোতেই সামরিক বাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী করা হয়।
- সামরিক বাহিনীর প্রভাব বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং মিডিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে।
- বেসামরিক প্রশাসনের তুলনায় সামরিক বাহিনীর সংগঠন ও কার্যকারিতা বেশি দক্ষ ছিল।
৪. অর্থনৈতিক কারণ
- সামরিক বাহিনী দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত।
- রাজনৈতিক শাসকদের অর্থনৈতিক দুর্নীতি এবং অযোগ্যতার কারণে সামরিক বাহিনী নিজেদের কার্যকর শাসক হিসেবে তুলে ধরে।
৫. বিদেশি শক্তির সমর্থন
- শীতল যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সমর্থন দেয়।
- সামরিক বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত হয়।
৬. আইন ও শৃঙ্খলার অবনতি
- রাজনৈতিক শাসনকালে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং সুশাসনের অভাব সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- জনগণের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হয় যে সামরিক বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো করতে সক্ষম।
৭. পাকিস্তানের সংবিধানের দুর্বলতা
- পাকিস্তানের সংবিধান সামরিক হস্তক্ষেপ রোধ করার মতো শক্তিশালী ছিল না।
- বিভিন্ন সময় সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত বা পরিবর্তন করেছে।
৮. বেসামরিক সরকারের সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা
- রাজনৈতিক নেতারা নিজেরা শক্তিশালী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় সামরিক বাহিনীর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
- এই নির্ভরশীলতা সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরিণতি
ইতিবাচক দিক:
- সামরিক শাসনের মাধ্যমে অস্থিরতা এবং আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন হয়েছে।
- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
নেতিবাচক দিক:
- গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব ব্যাহত হয়েছে।
- মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধী দলের দমন।
- ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা।
- পূর্ব পাকিস্তানে শোষণ এবং বৈষম্য, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীনতার আন্দোলনের কারণ হয়।
উপসংহার
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দ্বারা ক্ষমতা দখল ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের ফল। সামরিক শাসন হয়তো তাৎক্ষণিক স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছে, তবে এটি গণতন্ত্রের বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সুশাসনের অভাবে সামরিক শাসনের সম্ভাবনা সবসময়ই রয়ে গেছে।
Q7. শ্রীলংকার শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা
শ্রীলংকার শাসন পদ্ধতি
শ্রীলংকা একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশটির শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রিক এবং এটি ১৯৭৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। শ্রীলংকার শাসন পদ্ধতি রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি সংমিশ্রণ।
শ্রীলংকার শাসন পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য
১. রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি
- শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারের প্রধান (প্রধান নির্বাহী) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি জনগণের ভোটে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
- রাষ্ট্রপতির কাছে বহুমাত্রিক ক্ষমতা থাকে, যার মধ্যে রয়েছে:
- মন্ত্রিসভার নিয়োগ।
- আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
- জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা।
২. সংসদীয় গণতন্ত্রের উপাদান
- শ্রীলংকার আইন প্রণয়ন সংস্থা হলো এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ।
- সংসদ ২২৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত, যাঁদের সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত করা হয়।
- সংসদ আইন প্রণয়ন, বাজেট অনুমোদন এবং সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে।
৩. সংবিধানের আধিপত্য
- শ্রীলংকার শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের ওপর নির্ভরশীল।
- সংবিধান সর্বোচ্চ আইন এবং এর বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
৪. বিচার বিভাগ
- শ্রীলংকার বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে।
- সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত, যা সংবিধানের ব্যাখ্যা দেয় এবং সাংবিধানিক বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
- বিচার বিভাগ সরকারের কার্যক্রমের বৈধতা যাচাই করে।
৫. এককেন্দ্রিক শাসন পদ্ধতি
- শ্রীলংকার শাসন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়কৃত।
- প্রাদেশিক সরকার থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বেশি।
৬. রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন
- শ্রীলংকায় বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান।
- সাধারণত দুইটি প্রধান দল, শ্রীলংকা পিপলস ফ্রন্ট (SLPP) এবং ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (UNP), রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে।
- নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচনের আয়োজন করে।
শ্রীলংকার শাসন পদ্ধতির চ্যালেঞ্জসমূহ
১. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ
- রাষ্ট্রপতির কাছে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এটি স্বৈরতান্ত্রিকতার ঝুঁকি তৈরি করে।
২. রাজনৈতিক অস্থিরতা
- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এবং ক্ষমতার লড়াই শাসন ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
৩. অর্থনৈতিক সংকট
- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট শাসন ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি করেছে।
- জনগণের মধ্যে শাসক দলের প্রতি অসন্তোষ বাড়ছে।
৪. জাতিগত ও ধর্মীয় সমস্যা
- তামিল এবং সিংহলি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাত শ্রীলংকার শাসন ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
৫. দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতা
- দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব শাসন ব্যবস্থার কার্যকারিতা হ্রাস করে।
উপসংহার
শ্রীলংকার শাসন ব্যবস্থা একটি মিশ্র পদ্ধতি, যেখানে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্ব এবং সংসদীয় কার্যক্রম উভয়েরই প্রভাব রয়েছে। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি শাসন ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রভাবিত করছে। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং কার্যকর নীতি গ্রহণের মাধ্যমে শ্রীলংকা এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারে।
Q8. জাতিগঠন বলতে কি বুঝ? ভারতের জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় কংগ্রেস এর ভূমিকা
জাতিগঠন: সংজ্ঞা ও ধারণা
জাতিগঠন (Nation Building) একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র বা জাতি নিজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস এবং সমষ্টিগত পরিচয় তৈরি করে এবং সমাজের মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও সমন্বয়ের অনুভূতি প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিগঠনের মাধ্যমে একটি সমাজ তার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে এবং জাতির মানুষের মধ্যে একত্রিত হওয়ার একটি অভ্যন্তরীণ চেতনা সৃষ্টি হয়।
জাতিগঠন সাধারণত কেবল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়াও, যা জাতির বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠা করে। জাতিগঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতীয় অখণ্ডতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
ভারতের জাতিগঠন প্রক্রিয়া ও কংগ্রেসের ভূমিকা
ভারতের জাতিগঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় ঔপনিবেশিক যুগে, যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতের জনগণ বিভিন্ন জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিকভাবে বিভক্ত ছিল। ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে কংগ্রেস এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম
ভারতের জাতিগঠন প্রক্রিয়া মূলত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে শুরু হয়। ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে কংগ্রেস বিভিন্ন আন্দোলন এবং সংগ্রামের মাধ্যমে জাতিগত বিভেদ এবং শোষণের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়।
- ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা: কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কংগ্রেস, ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে।
- ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং কংগ্রেসের ভূমিকা: বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কংগ্রেস একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে, যা জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে।
২. বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত বিভেদ মোকাবেলা
ভারত অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় দেশ, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং বহু ভাষার মানুষ বসবাস করে। কংগ্রেস এই সকল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
- আলিগড় আন্দোলন: আলিগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের মধ্যে শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়।
- সংস্কৃতির ঐক্য প্রতিষ্ঠা: কংগ্রেস ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব তুলে ধরে, যাতে জাতিগত একতার অনুভূতি তৈরি হয়।
৩. গান্ধীজি এবং অহিংসা আন্দোলন
মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি অহিংসা, সত্যাগ্রহ এবং নির্যাতিত জনগণের প্রতি সহানুভূতির মাধ্যমে দেশবাসীকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন।
- নমক আন্দোলন (১৯৩০): গান্ধীজির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই আন্দোলন ভারতীয় জনগণের মধ্যে ঐক্য এবং জাতীয় চেতনা জাগ্রত করে।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২): ব্রিটিশ শাসনকে সমাপ্ত করতে এই আন্দোলন সমগ্র দেশব্যাপী চলেছিল এবং এতে ভারতীয় জনগণ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রামে অংশ নেয়।
৪. মুসলিম লীগের দাবি ও কংগ্রেসের সাড়া
১৯৪৭ সালে ভারতের ভাগ হওয়া (পাকিস্তান সৃষ্টি) ছিল ভারতের জাতিগঠন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবি তোলার পর কংগ্রেস তার সীমাবদ্ধতাগুলো এবং রাজনৈতিক কৌশল পর্যালোচনা করে। কংগ্রেসের মধ্যে এই বিষয়ে কিছু বিতর্ক ছিল, তবে তারা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের দাবি মেনে নিয়ে দেশভাগের প্রক্রিয়া গ্রহণ করে।
৫. সংবিধান প্রণয়ন এবং জাতিরাষ্ট্র গঠন
ভারত স্বাধীনতা অর্জনের পর, কংগ্রেস একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে ভারতকে একটি সংবিধানিক গণতান্ত্রিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
- ড. বি. আর. আম্বেডকরের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন: ভারতীয় সংবিধান জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি কার্যকর উপায় হয়ে দাঁড়ায়।
- সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন: কংগ্রেস সরকারের অধীনে অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতি প্রণীত হয়, যা জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য কমিয়ে আনে এবং দেশব্যাপী সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
উপসংহার
ভারতের জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদ মীমাংসা, সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করার জন্য কংগ্রেস ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতীয় জাতি একত্রিত হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেয় এবং জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন