Noarin Afroz Miss - History of the Emergence of Independent Bangladesh
Q1. ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্য ও সমস্যাবলী
---
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুসারে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় । কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতি অনুযায়ী পূর্ব বাংলা পৃথক রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়নি । দীর্ঘ ২৪ বছর পূর্ব বাংলাকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় । এসময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতি অনুসরণ করে । এরই প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ।
রাজনৈতিক বৈষম্য: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী করে রাখা হয়। লাহোর প্রস্তাবে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলেও পাকিস্তানি শাসকরা প্রথম থেকেই এ বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করে । গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের মাধ্যমে তারা দেশ শাসন করতে থাকে । তারা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শোষণ চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধি ঘটায় । বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর দমন-নিপীড়ন চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ অচল করে রাখে । বারবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলার জাতীয় নেতাদের অন্যায়ভাবে জেলে বন্দী করে রাখে । সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় বাঙালি প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল খুবই কম। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকরা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দিতে অনীহা প্রকাশ করে । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সরকারকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করে । পরবর্তী মন্ত্রিসভাগুলোকে বারবার ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকার্য অচল করে রাখে । অবশেষে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয় ।
সামরিক বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক শাসনের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল সামরিক বৈষম্য। সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অতি নগণ্য। প্রথম থেকেই সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পদ পাঞ্জাবিরা দখল করে রেখেছিল । তারা বাঙালিদের সামরিক বাহিনী থেকে দূরে রাখার নীতি গ্রহণ করে । সামরিক বাহিনীর নিয়োগের ক্ষেত্রে যে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে ৬০% পাঞ্জাবি, ৩৫% পাঠান এবং মাত্র ৫% পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অংশ ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারণ করা হয় । বাঙালির দাবির মুখে সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তা ছিল নগণ্য । ১৯৫৫ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর মোট ২২১১ জন কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ৮২ জন । ১৯৬৬ সালে সামরিক বাহিনীর ১৭ জন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন বাঙালি। আইয়ুব খানের শাসনামলে মোট বাজেটের ৬০% সামরিক বাজেট ছিল। এর সিংহভাগ দায়ভার বহন করতে হতো পূর্ব পাকিস্তানকে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার প্রতি অবহেলা দেখানো হতো ।
অর্থনৈতিক বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে । এ কারণে পূর্ব পাকিস্তান কখনও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি । প্রাদেশিক সরকারের হাতে মুদ্রাব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কেন্দ্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পূর্ব পাকিস্তানের সকল আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত । কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সকল ব্যাংক, বিমা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে । ফলে সহজেই সকল অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল । উদ্বৃত্ত আর্থিক সঞ্চয় পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকত বিধায় পূর্ব পাকিস্তানে কখনও মূলধন গড়ে ওঠেনি ।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সকল পরিকল্পনা প্রণীত হতো কেন্দ্রীয় সরকারের সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি না থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করত । জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানে তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়। প্রথমটিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ১১৩ কোটি ও ৫০০ কোটি রুপি, দ্বিতীয়টিতে বরাদ্দ ছিল ৯৫০ কোটি রুপি এবং ১৩৫০ কোটি রুপি। তৃতীয়টিতে পূর্ব ও পশ্চিমের জন্য বরাদ্দ যথাক্রমে ৩৬% ও ৬৩% । রাজধানী উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের বেশিরভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। ১৯৫৬ সালে করাচির উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয় ৫৭০ কোটি টাকা, যা ছিল সরকারি মোট ব্যয়ের ৫৬.৪% । সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের মোট সরকারি ব্যয়ের হার ছিল ৫.১০% । ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইসলামাবাদ নির্মাণের জন্য ব্যয় করা হয় ৩০০ কোটি টাকা, আর ঢাকা শহরের জন্য ব্যয় করা হয় ২৫ কোটি টাকা। পূর্ব পাকিস্তানে কাঁচামাল সস্তা হলেও শিল্প-কারখানা বেশিরভাগ গড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে কিছু শিল্প গড়ে উঠলেও তার অধিকাংশের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ফলে শিল্পক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে নির্ভরশীল থাকতে হতো পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর। পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বর্ণ এবং টাকা-পয়সা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বর্ণ ও টাকা-পয়সা পূর্ব পাকিস্তানে আনার ওপর সরকারের বিধিনিষেধ ছিল ।
সামাজিক বৈষম্য: রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, ডাকঘর, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশি সুবিধা ভোগ করত। সমাজকল্যাণ ও সেবামূলক সুবিধা বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানিরা পেত । ফলে সামগ্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল ।
সাংস্কৃতিক বৈষম্য: দুই অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% । বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল হাজার বছরের পুরনো। অপরদিকে ৪৪% জনসংখ্যার পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল । উর্দুভাষী ছিল মাত্র ৩.২৭% । অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষা ও সুসমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা । প্রথমেই তারা বাংলা ভাষাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে এবং বাংলা ভাষাকে উর্দু বর্ণে লেখানোর ষড়যন্ত্র শুরু করে । বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত, নাটক, সাহিত্য । বাঙালি সংস্কৃতিতে আঘাত হানার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রচনাবলি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে । পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে হিন্দু প্রভাব বলে উল্লেখ করে সেখানেও বাধাদানের চেষ্টা করা হয় ।
Q2. ভাষা আন্দোলন ও বাঙ্গালির আত্ম পরিচয়
বারবার আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল যাতে বাংলা ভাষায় এই অঞ্চলের মানুষ কথা বলতে না পারে। যদি ভারতবর্ষ ভাগ হয় তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে একটি বিতর্ক অবশ্য বেশ আগে থেকেই চলছিল। সে সময় অবশ্য পাকিস্তানের স্পষ্ট কোনো ধারণাও ছিল না।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক হাজার ২০০ মাইলের অধিক দূরত্ব, ভাষার ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্ব থাকলেও শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে দুটি আলাদা অঞ্চলকে একসাথে জুড়ে দেয়া হয়।
এরপরই ভাষা নিয়ে বিতর্ক তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে। এর আগে ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু প্রবর্তনের সুপারিশ করলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা বাতিল হয়ে যায়। এরপর ভাষা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্ক হলেও ১৯৪৭ এর পর সেটি অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করে।
অবিশ্বাসের শুরু : ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ট্রেনের টিকেট, ডাকটিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন (ভাষা মতিন) ও আহমেদ রফিক তাদের লেখা ‘ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য’ শীর্ষক বইতে উল্লেখ করেছেন— ‘প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ।’ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ অবশ্য উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন ১৯৪৭ সালে। তখন ভাষা নিয়ে বিতর্ক আবারো জেগে উঠেছিল। ততদিনে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
তমদ্দুন মজলিসের উত্থান : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহু সংগঠন ও ব্যক্তির অবদান থাকলেও তমদ্দুন মজলিস ও এর প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেমের অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো। এই সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষার দাবি প্রথম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। তরুণ শিক্ষক আবুল কাশেম ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করলেন তমদ্দুন মজলিস। কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাসেমের মোট তিনটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হলো ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম বই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ থেকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই একটিমাত্র স্লোগানই সব মত ও পথকে একটি মোহনায় নিয়ে এসেছিল। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনই আমাদের রাজনীতিবিদদের সর্বপ্রথম এক ও অভিন্ন প্লাটফর্মে নিয়ে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথমবার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর যার আহ্বায়ক ছিলেন নুরুল হক ভূঁইয়া। দ্বিতীয় বার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১৯৪৮ এর ২ মার্চ। এম আর মাহবুবের লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলা হয়, ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সমপ্রসারণ করে প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের বিস্তার : মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।’ ১৯৪৮ সাল থেকেই ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৪৮ সালের এই দিনে পূর্ব বাংলার সাহসী ছাত্রজনতা একটি সর্বাত্মক ও কার্যকর ধর্মঘট পালনের মধ্য দিয়ে ভাষার দাবিকে জোরালো ও আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসে। আন্দোলন ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিক, মজুরসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের এই দিনে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সে সময়কার উজ্জ্বল ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেকে। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জোরদার হতে শুরু করে।
জিন্নাহ ও পাকিস্তানি শাসকদের অনমনীয় অবস্থান : সে সময় পাকিস্তানে ৫৬% এর অধিক বাংলাভাষী থাকলেও পাকিস্তান সরকার বারবার বাংলা ভাষার দাবি অস্বীকার করে এসেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। একনায়কী স্বভাবের জিন্নাহ ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনা সভায় এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তনের ছাত্রসভায় বেশ জোরালো ভাষায় বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। যারা এর বিরোধিতা করে, তারা পাকিস্তানের দুশমন। তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। কার্জন হলে উপস্থিত অসংখ্য ছাত্র তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ করে ওঠেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন আবার ঘোষণা করলেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ পুনরায় আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
অগ্নি স্ফুলিঙ্গের বিস্ফোরণ : খাজা নাজিমুদ্দিন বাঙালি হয়েও ঘোষণা দিলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে বঞ্চনার অনুভূতি আরও জোরালো হয়ে জেগে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি সভা ও ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এভাবে আন্দোলন চলতে থাকে। ছাত্রজনতার নানামুখী আন্দোলন ও প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে উপস্থিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারির ভোর। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার।
সেদিন সারা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতারা রাত থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করলেও সকাল হতেই পুলিশ সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কর্ডন করে ফেলে। নেতৃবৃন্দের নির্দেশ সংবলিত চিরকুট আগে থেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়া হয়। সময় গড়ানোর সাথে সাথেই সভাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতা শামছুল আলম, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খানসহ আরও কয়েকজন ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে মত দিলেও আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে অবস্থান নেন।
সভায় গাজীউল হক, আব্দুল মতিনরা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন যাতে করে ছাত্ররা ব্যাপক উদ্বুদ্ধ হয়। ঠিক হয় ১০ জনের একটি করে দল বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। ১০ জন বের হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাবটি পেশ করেন আবদুস সামাদ আজাদ। পরবর্তীতে যাকে বিখ্যাত ‘১০ জনী মিছিল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তার মতে, শিক্ষার্থীরা যদি একত্রে মিছিলে নামে তবে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই প্রতি দফায় তারা ১০ জন করে রাস্তায় মিছিল বের করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী এ বক্তব্য সমর্থন করেন এবং কলাভবনের গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। প্রথম দলের নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলী (সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা)। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী দলগুলোর মধ্যে ছাত্রীদের একটি দলও যোগদান করে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্ররা দৌঁড়ে কলাভবনের পুকুরে এসে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছে আবার মিছিলে যোগ দেন। ছাত্ররা আত্মরক্ষার্থে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পুলিশের পাল্টা হামলায় ছাত্রদের একটি বড় অংশ মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হয়। এখানে পুলিশ আকস্মিকভাবে ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আব্দুল জব্বার ঘটনাস্থলে নিহত হন। একই বছরের এপ্রিল মাসে আব্দুস সালাম মেডিকেল কলেজে মারা যান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে সেদিন ও পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরও অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ : প্রায় দুই বছর পর ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। সংবিধানের ২১৪নং অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ : ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তা কখনো এক হতে পারে না। যার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার মাধ্যমে।
Q3. যুক্তফ্রন্ট ও যুক্তফ্রন্টের পটভূমি ও নির্বাচনের ফলাফল
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচন ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । মূলত এ নির্বাচন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তার দোসরদের শোষণের বিরুদ্ধে এক 'ব্যালট বিপ্লব' । পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিভিন্ন উপদল, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যর্থ শাসন, অঞ্চলভেদে বৈষম্যমূলক নীতি প্রভৃতির কারণে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন আবশ্যক হয়ে পড়ে । বিশেষ করে এ সময় পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শাসনের চরম ব্যর্থতার ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক- শ্রমিক পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। আগে থেকেই ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মুসলিম লীগ সরকার পরাজয়ের আশঙ্কায় নানা টালবাহানা করে নির্বাচনের তারিখ বারবার পিছিয়ে দেয় । অবশেষে সরকার পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ধার্য করে ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ।
যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি এবং ২১ দফা কর্মসূচি:
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুসলিম লীগ ছিল পুরাতন ও বড় দল । এছাড়া পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করত মুসলিম লীগ। ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম লীগকে পরাজিত করার কৌশল হিসেবে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালের ১৪ই নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যুক্তফ্রন্ট মূলত পাঁচটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় । ১. মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ২. শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক- শ্রমিক পার্টি, ৩. মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি, ৪. হাজী দানেশের বামপন্থী গণতন্ত্রী দল ও ৫. খিলাফত-ই-রাব্বানি। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল 'নৌকা'। আওয়ামী মুসলিম লীগের নির্বাচনী কর্মসূচির ৪২ দফার প্রধান প্রধান দাবি নিয়ে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয় । পূর্ব বাংলার গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে প্রণীত এই ২১ দফা কর্মসূচির মুখ্য রচয়িতা ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ । প্রধান দফাগুলো সংক্ষেপে বর্ণিত হলো :
- বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ;
- বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা ;
- পাটশিল্পকে জাতীয়করণ করা ;
- কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন করা ;
- অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা ;
- মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ;
- '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণ ;
- ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা ;
- ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ;
- আইন পরিষদের মেয়াদ কোনোভাবেই বৃদ্ধি না করা ;
- আইন পরিষদের আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন দিয়ে তা পূরণ করা ;
সর্বোপরি এ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ ও অবাঙালি নেতৃত্বের প্রতি বাঙালির মনে ব্যাপক অনাস্থা জন্মায় । তারা বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা বাঙালির প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীর আদর্শের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাবাসী স্বায়ত্তশাসনের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে ।
Q4. ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন - মাউন্ট ব্যাটেন
ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সোনালি ফসল ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন (The Indian Independent Act. 1947)। এ আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে দীর্ঘ দু শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। মূলত ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা নিরসনকল্পে ১৯৪৬ সালের ৩ জুন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে Indian Independent Act, 1947 পাস হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের প্রেক্ষাপট
মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণে ভারতে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠন নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এ সময় ভারতের নতুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু এ প্রচেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হয়ে ঘোষণা করেন, “ভারত বিভাগ ছাড়া ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প উপায় নেই।” পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতায় কংগ্রেস ভারত বিভক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালের ৩ জুন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে এক ঘরোয়া বৈঠকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন যে পরিকল্পনা তুলে ধরেন তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইনের খসড়া বিল পেশ করা হয় এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক ১৮ জুলাই আইনটি পাস হয়।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন 1947-এর বৈশিষ্ট্য
ভারত বিভাজন: আইনটি ধর্মীয় লাইনের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারতকে দুটি পৃথক রাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করার আহ্বান জানায়। ভারত একটি প্রধানত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যখন পাকিস্তান একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনের অবসান: আইনটি ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি চিহ্নিত করে। এটি ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সম্পূর্ণ আইনী স্বাধীনতা প্রদান করে, কার্যকরভাবে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান ঘটায়।
ক্ষমতা হস্তান্তর: আইনটি 15 আগস্ট, 1947 এর স্বাধীনতার তারিখ নির্ধারণ করে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার রূপরেখা দেয়। এটি প্রদেশগুলিকে সিদ্ধান্ত নিতে দেয় যে তারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে চায় কিনা।
পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন: পাঞ্জাব ও বাংলার প্রদেশগুলি বিভাজন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, যার ফলে বড় আকারের স্থানান্তর এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছিল। আইনটি এই প্রদেশগুলির সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি কাঠামো প্রদান করেছে।
শাসন কাঠামো: আইনটি তাদের নিজস্ব গণপরিষদগুলির সাথে দুটি পৃথক আধিপত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল – একটি ভারতের জন্য এবং একটি পাকিস্তানের জন্য। প্রতিটি আধিপত্যকে তার নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন 1947-এর গুরুত্ব
ঐতিহাসিক স্থানান্তর: আইনটি স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ এবং কঠিন সংগ্রামের সমাপ্তি চিহ্নিত করেছে, এটি ভারতীয় ইতিহাসে একটি জলাবদ্ধ মুহূর্ত হয়ে উঠেছে। এটি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্ব-শাসনে সফল রূপান্তরের প্রতিনিধিত্ব করে।
ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র: আইনটি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ভারতের সংবিধান, 1950 সালে গৃহীত, এই নীতিগুলি প্রতিফলিত করে এবং আজও জাতিকে গাইড করে চলেছে।
বিভাজন এবং অভিবাসন: যদিও দেশভাগ ছিল একটি মর্মান্তিক ঘটনা, এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব এবং ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্যকে মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এটি ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম অভিবাসনের দিকে পরিচালিত করেছিল।
নেতৃত্বের উত্তরাধিকার: মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো নেতারা ব্রিটিশদের সাথে আলোচনায় এবং তাদের নিজ নিজ জাতির ভাগ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাদের নেতৃত্ব এই অঞ্চলে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সম্পর্ক: এই আইনটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জটিল সম্পর্কের মঞ্চ তৈরি করে, যা কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক, আঞ্চলিক এবং কূটনৈতিক বিরোধের দিকে পরিচালিত করে। দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Q5. লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি, ধারা ও ফলাফল
1940 সালের লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান সৃষ্টির দিকে যাত্রার একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। 23 মার্চ, 1940 সালে লাহোরে অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রণীত, এই প্রস্তাবটি একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে পাকিস্তানের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এটি অখন্ড ভারতের মধ্যে স্ব-নিয়ন্ত্রণ ও স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ লক্ষ মুসলমানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। এই আর্টিকেলে, লাহোর প্রস্তাব 1940, গুরুত্ব এবং ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
লাহোর প্রস্তাব 1940 ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য বোঝার জন্য, আমাদের প্রথমে 1940-এর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ভারতে বিদ্যমান রাজনৈতিক আবহাওয়া উপলব্ধি করতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায় এবং সংস্কৃতির দেশ, তবুও এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছিল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতারা ভারতের ভবিষ্যতের বিষয়ে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে কথা বলছিলেন।
এই পটভূমির মধ্যে, মুসলিম লীগ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে, ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার উদ্বেগ এবং আকাঙ্ক্ষাগুলিকে সমাধান করার জন্য লাহোরে সমবেত হয়েছিল, যা বৃহত্তর ভারতীয় রাজনৈতিক ভূখণ্ডের মধ্যে প্রান্তিক বোধ করেছিল। লাহোর প্রস্তাব এই উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল, একটি অখণ্ড ভারতের মধ্যে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে।
লাহোর প্রস্তাব 1940 গুরুত্ব
লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানায় যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এটি মুসলিম লীগের রাজনৈতিক লক্ষ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চিহ্নিত করেছে, যেটি পূর্বে অখন্ড ভারতের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষার চেষ্টা করেছিল। একটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাবের দাবি পাকিস্তানের ভবিষ্যত রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার পিছনে ব্রিটিশ ভারত জুড়ে মুসলমানদের একত্রিত করতে এই প্রস্তাবটি সহায়ক ছিল। এটি মুসলমানদের তাদের অধিকার এবং আকাঙ্ক্ষা জাহির করার জন্য একটি সাধারণ রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম প্রদান করেছিল। ব্রিটিশ এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে পরবর্তী আলোচনায় এই ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
লাহোর প্রস্তাব একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবিকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। মুসলিম নেতা এবং প্রতিনিধিদের অপ্রতিরোধ্য সমর্থনে এটি পাস করা হয়েছিল, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ধারণার জন্য ব্যাপক সমর্থন প্রদর্শন করে।
ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস পার্টির সাথে আলোচনার সময় একটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাবের দাবি মুসলিম লীগকে সুবিধা দেয়। এটি আলোচনার একটি মূল কারণ হয়ে ওঠে যা শেষ পর্যন্ত 1947 সালে ভারত ভাগের দিকে পরিচালিত করে।
লাহোর প্রস্তাব 1940 ফলাফল
একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য লাহোর প্রস্তাব দাবি শেষ পর্যন্ত 1947 সালে ভারতকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করে: ভারত ও পাকিস্তান। ভারত একটি প্রধানত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল, অন্যদিকে পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য একটি স্বদেশ হিসাবে তৈরি হয়েছিল। এই বিভাজনের ফলে উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যাগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং এর ফলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং লক্ষাধিক লোক বাস্তুচ্যুত হয়।
14 আগস্ট, 1947-এ লাহোর প্রস্তাব সরাসরি পাকিস্তানকে একটি পৃথক জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে। পাকিস্তান দুটি ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল: পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) 1947 সাল পর্যন্ত। পরবর্তী স্বাধীনতা 1971 সালে।
একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি এবং পরবর্তী বিভাজনের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে হিন্দু, মুসলমান এবং শিখদের মধ্যে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং উত্তেজনা দেখা দেয়। অশান্তির এই সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এবং অগণিত প্রাণ হারিয়েছিল।
লাহোর প্রস্তাব দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং পরবর্তীতে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থানের দিকে পরিচালিত ঘটনাগুলির গতিপথকে রূপ দেয়। এটি ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের উপর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, যা বছরের পর বছর ধরে দ্বন্দ্ব এবং উত্তেজনা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে
Q6. দ্বি-জাতিতত্ব, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির অপরিহার্যতা
ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রদত্ত ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের’ ধারণা আজও চিরস্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। মূলত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রচার করতে থাকেন যে, মুসলমানগণ একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং তারা ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়। তাই তিনি একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির দাবি করেন। তাঁর এ দাবির প্রেক্ষিতেই দ্বিজাতি ধারণাটির উৎপত্তি ঘটে এবং পরবর্তীতে এ ধারণা ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। যার গুরুত্ব মুসলিম সমাজে অপরিসীম।
তাই এ দুই জাতির মিলনে কখনো একটি জাতিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। তাঁর ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ২৩ তম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি তাঁর ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ বা Two nation theory’ উত্থাপন করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “যে কোন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মুসলমানরা একটা জাতি।
তাই তাদের প্রয়োজন একটা পৃথক আবাসভূমি, একটা ভূখণ্ডের এবং একটা রাষ্ট্রের।” (By any international standard the Muslims are a nation. So they are in need of a separate homeland, a territory and a state)। এ ঘোষণা ঐতিহাসিক ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ নামে খ্যাত।
জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ঘোষণার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিম্নরূপ:
- ভারতের মুসলমানরা একটি জাতি, হিন্দুরা একটি জাতি।
- এই দুই জাতির ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, আদর্শ সবকিছুই ভিন্ন।
- তাই তাদের একই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একত্রে বসবাস করা সম্ভব নয়।
- ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজন।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রভাব: দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই তত্ত্বের প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও মানচিত্রিক পরিবর্তন ঘটে।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রভাব সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট উদাহরণ হল:
- ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের সমস্ত আসনে জয়লাভ করে।
- দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়।
- ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। এই বিভাজনের ফলে প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের আবাসস্থল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রভাব আজও ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজকে প্রভাবিত করছে।
১৯৪০ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের গুরুত্ব: দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই তত্ত্বের ফলে ভারতে ধর্মীয় দাঙ্গা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তবুও তত্ত্বটি ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৪০ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের গুরুত্ব নিম্নরূপ:
- এটি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করে।
- এটি ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতা প্রদান করে।
- এটি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের সূচনা করে।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন এখনও পর্যন্ত চলমান।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব’ ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। তাঁর এ কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সমগ্র মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা। কেননা অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা যেমন অসম্ভব ছিল, তেমনি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাও সম্ভব ছিল না। তাই এ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এবং মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি গঠনের লক্ষ্যে জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব’ উত্থাপন ও প্রচার করেন। আর মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধতার কারণেই এক সময় ভারত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং মুসলমানগণ পাকিস্তান নামে নতুন রাষ্ট্র গঠন করে। সুতরাং সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে জিন্নাহর “দ্বিজাতিতত্ত্ব’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির অপরিহার্যতা
Q7. বাঙালি সংকর জাতি ও বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির সমন্বয়ে যে জাতি গোষ্ঠির উদ্ভব হয় তাকে সংকর জাতি বলা হয়। বাঙ্গালি একটি সংকর জাতি বলা হয় কারণ বাঙ্গালি এক বা একক কোন জাতি গোষ্ঠি নয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির সমন্বয়ে বাঙ্গালি জাতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই বাঙ্গালি জাতিকে একটি সংকর জাতি বলা হয়।
বাঙ্গালি এক বা একক কোন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নয়। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মিশ্রণ-বিরোধ ও সমন্বয়ের মাধ্যেমে বাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠি তৈরি হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিগত পরিচয় নির্ধারণ করতে যারা নিরলসভাবে কাজ করেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন স্যার হার্বার্ট রিজলি, পন্ডিত র বিরজশঙ্কর গুহ, রামপ্রসাদ চন্দ্র সহ আরও অনেকেই। পন্ডিত বা বিশেষজ্ঞদের মত হলো, বাঙ্গালি জাতি হলো নতুন একটি মিশ্র জাতি। ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে প্রথম যে জনগোষ্ঠি বসবাস শুরু করে তারা হলো নিগ্রোয়েড বা অস্ট্রেলয়েড শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ধীরে ধীরে এদের সাথে যুক্ত হয়েছে দ্রাবিড়, আলপিয়ান, মঙ্গলয়েড, নর্ডিক, আরবীয় সহ আরও বহু জাতি। আর্যরা বাংলায় আসে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আগেই। এরপর মিশ্রণ অব্যহত থাকে। অনেকগুলো জাতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠেছে এই বাঙ্গালি জাতি। এর মূল কাঠামো সৃষ্টির কাল বা প্রাগহৈতিহাসিক যুগ থেকে মুসলিম অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত।
১। দ্রাবিড়
নাক চওড়া, মাথা লম্বা, ও উন্নত চুল কালো ও বাদামি। গায়ের রং কালো থেকে বাদামি। ঠোট প্রুরু, উচ্চতা খাটো মুখ গহব্বর বড় আকৃতির, মুখাবয়ব তীক্ষ্ণ ও স্পষ্ট। সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা দ্রাবিড় ভাষাভাষী আলপাইন গোত্রের এই নরগোষ্ঠী মূলত ভূ-মধ্যসাগরীয়।
২। মঙ্গলয়েড
চোখের পাতা সামনের দিকে ঝোলানো, গায়ের রঙ পীতাভ থেকে বাদামী, চুলের রং কালো ও ঋজু, মাথার আকৃতি গোল। এই জনগোষ্ঠি দক্ষিণ-পশ্চিম চীন থেকে এই অঞ্চলে এসেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে এদের মূল বসবাস।
৩। আর্য বা ককেশীয় জনগোষ্ঠি
প্রটো অস্ট্রেলয়েডদের পর ককেশীয়রা এদেশে প্রবেশ করে তাই এদেরকে আর্য বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, বাংলাদেশের জনপ্রকৃতিতে আর্য ভাষাভাষী একটি ধারা এসে প্রভাবিত করে। আর্যরা দ্রাবিড় ভেড্ডিদের পদানত করে ভারতবর্ষে বর্ণপ্রথার জন্ম দেন। শরীরের গড়ন বলিষ্ঠ, মাথার আকৃতি লম্বা এবং সরু নাক আর্যদের প্রধান লক্ষণ।
৪। নেগ্রেটো
গায়ের রঙ কৃষ্ণবর্ণ, খর্বাকৃতি, বেঁটে, ঠোঁট প্রুরু এবং নাক অতি চ্যাপ্টা কৃতির। এই নেগ্রেটো জাতিগোষ্ঠি বাংলা জনগোষ্ঠির প্রথম স্তর। সুন্দরবন, যশোরের বাশঝোড়, ময়মনসিংহ এবং নিম্নবঙ্গের জনগণের মধ্যে এর প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়।
৫। অস্ট্রিক বা অস্ট্রোলয়েড
নাক চওড়া, গায়ের রঙ মিশমিশে কালো, মাথার গড়ন লম্বাকৃতি, দেহের গড়ন বেঁটে কিংবা মধ্যকার। এরা অনেক সময় ডেভিড কিংবা নিষাদ নামেও পরিচিত। বাঙ্গালি জাতির মধ্যে অস্ট্রিক বা অস্ট্রোলয়েড জাতির প্রভাব সবচেয়ে বেশী। ধারণা করা হয়, আজ থেকে ৫ থেকে ৬ বছর আগে এরা এ অঞ্চলে বসবাস করার জন্য আসে। সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, ভূমিজ, মালপাহাড়ি, বাউরি, চন্ডাল সহ আরও অনেক জাতির সাথে অস্ট্রিক জনগোষ্ঠির সম্পর্ক রয়েছে। কুড়ি, পণ, চন্ডাল, প্রভৃতি হিসাব, চোঙ্গা, দা, লাউ, লেবু প্রভৃতি এসব অস্ট্রিক ভাষার শব্দ।
৬। আরব জাতি
সপ্তম ও অষ্টম শতকের সময়ে আরব জাতিরা বাংলায় আগমন করে। পরবর্তী সময়ে আফগান, তুর্কি, হাবশি, ইরানি, মোগল মুসলমানেরা এ বাংলা বসতি স্থাপন করে বাংলায় বসবাস শুরু করেন।
৭। ইউরোপীয় জাতি
ইউরোপীয় জাতি ১৬ শতকের সময়ে বাংলায় আগমন করে বাঙ্গালি জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপরে বাংলায় ইংরেজরা আগমন করে।
৮। আলপাইন জাতি
দ্রাবিড়দের পরে ভারতে আলপাইন জাতি প্রবেশ করে। বাঙ্গালি, গুজরাটি, মারাঠি, ওড়িশি জাতি পূর্ব পূরূষদের মধ্য অনেকেই আলপাইন জাতিগোষ্ঠির লোক ছিল। আলপাইনদের কোন কালে দল রাঢ়, সুক্ষ্ণ, বঙ্গ, পুন্ড এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করেন। এরা বিহার উড়িষ্যা হয়ে কাশী এবং পূর্ব আসামের কামরূপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এদের থেকে আজ আমরা বাঙ্গালি জাতিতে পরিণত হয়েছি
।
৯। আর্য ও পরবর্তী ধারা
আর্য জাতি ছাড়াও এই দেশে অনেক জাতি প্রবেশ করে বসতি স্থাপন করে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের সংমিশ্রণেও বাঙ্গালি জাতি গঠনে সহয়তা করে। পারস্যের তুর্কীস্তান থেকে সাবা জাতির লোকেরা এই দেশে আসে। এদেশে আসার পর তারা ভারতের পূর্বাঞ্চলে ও বাংলায় বসতি স্থাপন করেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙ্গালি জাতির উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-মতামত থাকলেও বাঙ্গালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব পাওয়া যায়নি। বর্তমান বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির মধ্য আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক জীবনযাত্রা, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুর মধ্যেই একই ধরনের পরিলক্ষিত হয়। তাই বাঙ্গালি জাতি একটি সংকর জাতি।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ: কোথা থেকে এলো বাংলা ভাষা
বাংলাদেশ সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের বারাক উপত্যকার রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সহ ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ কোটি বাঙালির এই মুখের ভাষার শুরুটা খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছরেরও আরো পেছনে। মহিমান্বিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের এই মাসে চলুন জেনে নেয়া যাক অতি প্রাচীন বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি
বাংলা ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রে। সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তির কিংবদন্তি থাকলেও বাংলা ভাষাবিদরা বিশ্বাস করেন, বাংলা মাগধী প্রাকৃত এবং পালির মতো ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে এসেছে।
ইন্দো-আর্য হল ইন্দো-ইরানীয় ভাষা উপবিভাগের একটি প্রধান শাখা, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রের পূর্বাঞ্চলীয় ধরন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চ্যাটার্জির মতে, বৈদিক এবং সংস্কৃত উপভাষাগুলোকে প্রাচীন ইন্দো-আর্য যুগের প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর মধ্যে আছে পালিসহ প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ, যেগুলো পাওয়া যায় সম্রাট অশোক এবং থেরাবাদ বৌদ্ধ কাননের শিলালিপিতে।
প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা যখন মগধ রাজ্যের অংশ ছিল, তখন মধ্য ইন্দো-আর্য উপভাষাগুলোর বেশ প্রভাব ছিলো বাংলায়। এই উপভাষাগুলো মাগধী প্রাকৃত নামে পরিচিত আর এটিই ছিলো আধুনিক বাংলা, বিহার, ও আসামের লোকেদের কথ্য ভাষা। এই ভাষারই বির্বতিত রূপ অর্ধ-মাগধী প্রাকৃত, যেখান থেকে প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে উদ্ভব হয় অপভ্রংশের। অতঃপর কালক্রমে এই অপভ্রংশ থেকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে জন্ম হয় বাংলা ভাষার।
বাংলা ভাষার বিবর্তন
বাংলা ভাষার বিবর্তনের তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে; পুরাতন, মধ্য এবং আধুনিক বাংলা।
পুরাতন বাংলা ছিল ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার পুরোহিত এবং পণ্ডিতদের সাহিত্যকর্মের ভাষা। এই সময়ের সাহিত্যের খুব কম চিহ্নই এখন অবশিষ্ট রয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শনের মধ্যে একমাত্র চর্যাপদ পাওয়া যায়। এটি বৌদ্ধধর্মের উপর ভিত্তি করে কবিতার একটি সংকলন, যা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়।
চতুর্দশ শতকে বাংলায় শুরু হয় মুসলমানদের সালতানাত। সালতানাত বাংলাকে এই অঞ্চলের সরকারী দরবারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ধারাবাহিকতায় ক্রমেই বাংলার স্থানীয় ভাষায় পরিণত হয় বাংলা।
ষোড়শ শতকে মুঘলরা বাংলা দখল করলে বাংলা ভাষার সাথে যোগসাজশ ঘটে ফার্সি ভাষার। বর্তমান বাংলা ভাষার আধুনিক রূপটি পাওয়া যায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলার নদীয়া অঞ্চলে কথিত উপভাষায়। এই ভাষাটির দুটি ভাগ; শুদ্ধ এবং চলিত। এগুলোর ভিত্তি গড়েছে প্রধানত মাগধী প্রাকৃত এবং পালিসহ তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও ইংরেজি।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষা করার দাবিতে বাংলা ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে লালন করে। ফলে ১৯৭১ এ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
মাৎস্যন্যায় রাজা শশাঙ্ক এর মৃত্যুর পর থেকে পাল রাজবংশের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। প্রায় সমসাময়িক লিপি, খালিমপুর তাম্রশাসন এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম কাব্যে পাল বংশের অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময়ের বাংলার নৈরাজ্যকর অবস্থাকে ‘মাৎস্যন্যায়ম্’ বলে উল্লেখ করা হয়।
শশাঙ্কের (৬০০-৬২৫ খ্রি) মৃত্যুর পর বঙ্গে (গৌড়-বাংলায়) বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর (৬৪৬/ ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) পর তাঁর সাম্রাজ্যেও নৈরাজ্য ও সংশয় দেখা দিলে, মন্ত্রীরা বলপূর্বক রাজ্য দখল করে নেয়। আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক শতক কালেরও বেশি সময় ধরে গৌড়ের ইতিহাস অস্পষ্ট ছিলো। চৈনিক দূত ওয়াং-হিউয়েন্-সের হঠকারিতায় তিববতের ক্ষমতাধর রাজা শ্রং-ছান-গেমপো বাংলায় পরপর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় দুটি নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে:গৌড় ও মগধে (পশ্চিম বাংলা ও দক্ষিণ বিহার) পরবর্তী গুপ্তগণ এবং বঙ্গ ও সমতট (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) খড়গ রাজবংশ। কিন্তু এ রাজবংশের কোনোটিই বাংলায় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি বলে ধারনা করা হয়।
খ্রিস্টীয় আট শতকের প্রথমার্ধে পুনঃপুনঃ বৈদেশিক আক্রমণে বাংলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কনৌজ রাজ যশোবর্মণের (৭২৫-৭৫২ খ্রি.) আক্রমণ। কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যশোবর্মণের গৌরবকে ম্লান করে দেন। গৌড়ের পাঁচ জন রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন বলে কলহন (কাশ্মীরের ঐতিহাসিক) উল্লেখ করেন। এ থেকে গৌড়ের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে স্থানীয় প্রধানগণ স্বাধীন হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ লিপ্ত হন। পুনঃপুনঃ বৈদেশিক আক্রমণ রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং তাতে বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তাই শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি বলা চলে। গোপালের উত্থানের আগে খ্রিস্টীয় আট শতকের মাঝামাঝি সময়ের রাজনৈতিক অবস্থাকে খালিমপুর তাম্রশাসনে (পাল আমলের লিপি) মাৎস্যন্যায়ম বলে উল্লেখ করা হয়। তিববতি সন্ন্যাসী তারনাথ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ’ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ মত সমর্থন করে লিখেন: ‘প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ ও বণিক স্ব স্ব গৃহে (অথবা প্রভাবাধীন এলাকায়) ছিলেন এক এক জন রাজা, কিন্তু সমগ্র দেশে কোনো রাজা ছিলেন না’।
সংস্কৃত শব্দ মাৎস্যন্যায়ম বিশেষ অর্থবহ। কৌটিল্য এর অর্থশাস্ত্র এ (১.৪.১৩-১৪) শব্দটির নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে: যখন দন্ডদানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন এমন অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা মাছের রাজ্য সম্পর্কে প্রচলিত প্রবচনের মধ্যে পরিস্ফুট। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোটটিকে গ্রাস করে, কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবেই। সমসাময়িক পাল লিপিতে এ অর্থবহ শব্দটির প্রয়োগ করে বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
উপরোক্ত বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শশাঙ্কের রাজত্বের পরবর্তী শতকে বাংলায় শাসন খুব অল্পই স্থিতিশীল ছিল। দেশটি অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাদের পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহের ফলে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। আইন-শৃঙ্খলা বিধানে সক্ষম কোন শক্তির অনুপস্থিতির ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাই মাৎস্যন্যায়ম্। সে সময়ে দৈহিক শক্তির প্রাধান্যে দেশ জুড়ে চলছিল অবাধ্য শক্তির উত্তেজনা। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল এ বিশৃঙ্খল অবস্থায় রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং মাৎস্যন্যায়মের অবসান ঘটান।
গোপাল কিভাবে ক্ষমতায় আসেন তা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, জনগণই গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেন। তিনি কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সমর্থন লাভ করেই রাজা হন ও মাৎস্যন্যায়মের অবসান ঘটিয়ে জনসমর্থন লাভ করেন। পাল লিপিতে দাবি করা হয়েছে যে, গোপাল ‘বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী লোকদের পরাভূত করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন’। অন্য কথায় বলা যায়, যারা বাংলায় মাৎস্যন্যায় অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তাদের তিনি সমূলে উৎপাটন করেন। এই নৈরাজ্যকর অবস্থার সামাজিক দিকগুলি নিরূপণের সহায়ক কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। তবে পরোক্ষ তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, শান্তি ও শৃঙ্খলার অভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্যে অধোগতি দেখা দেয়। আট শতকের পর থেকে তাম্রলিপ্তি বন্দরের প্রাধান্য হ্রাস ব্যবসা-বাণিজ্যের এ অবনতির ইঙ্গিত বহন করে। মহাস্থানের ধ্বংসস্তূপ থেকে বোঝা যায় যে, পাল আমলের মন্দির ও আশ্রমগুলি নির্মিত হয়েছিল গুপ্ত যুগ পূর্ববর্তী ও গুপ্তোত্তর যুগের ধ্বংসসূতপগুলির উপর। এতে ধারণা করা যায় যে, নৈরাজ্যের যুগেই ওই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিল। সেই নৈরাজ্যের সঙ্গে সম্ভবত পূর্ববর্তী ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটা সম্পর্ক ছিল। শক্তিশালী কোন রাজার অনুপস্থিতিতে সামন্ত প্রভুরা প্রত্যেকে ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম। তারা নৈরাজ্য সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সম্ভবত তাদের মধ্যকার কয়েকজনের বিচক্ষণতার ফলে আইন-কানুনহীন নৈরাজ্য পরিস্থিতির অবসান ঘটে। তারা একত্রিত হয়ে গোপালকে শাসন ক্ষমতায় বসায় ও মাৎস্যন্যায়ম এর বিলুপ্তি ঘটে।
Q9. বাংলা নামের ইতিহাস
বঙ্গ বা বাংলা নামের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। কারাে কারাে মতে, বঙ্গ নাম থেকেই বঙ্গাল এবং পরবর্তীতে বাঙালা নামের উৎপত্তি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, অতীতে বং নামের এক জনগােষ্ঠি এ অঞ্চলে বসবাস করত এবং তাদের নাম অনুযায়ী অঞ্চলটি বঙ্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। আবার অনেকেই মনে করেন জলমগ্ন স্যাঁতস্যাঁতে অঞ্চলকে বঙ্গ বা বংশ বলা হতাে। তাই নদী মেঘলা ও জলমগ্ন দক্ষিণাঞ্চল বঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে আসছে। অনেক হিন্দু ঐতিহাসিক মহাভারত, পুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রের ভিত্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, বলী রাজার ৫ জন সন্তান ছিল। যাদের নাম রাখা হয় :
(১) অঙ্গ;
(২) বঙ্গ;
(৩) কলিঙ্গ;
(৪) পুন্ড্র ও
(৫) সূহ্ম।
বলিরাজ এদেরকে ৫টি রাজ্য দেন এবং যে যে রাজ্যের সিংহাসনে আরােহণ করেন তার নামানুসারে সে রাজ্যের নামকরণ হয়। এদের মধ্যে বঙ্গ এর অধিকারভুক্ত দেশই বঙ্গ নামে পরিচিতি হয়। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন “ব্রাত্যজনের চরিত্র হরণের জন্য এটি একটা চিত্তাকর্ষক ব্রাহ্মণ্য প্রচার”। অপরদিকে, মুসলমানদের পুরাণ কাহিনী অনুসারে হযরত নূহ (আঃ)-এর এক পুত্রের নাম ছিল হাম, তার পুত্র হিন্দ,
আর হিন্দ এর দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল বং।” বং ও তার সন্তান সন্ততিগণ যে অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেন, সেই অঞ্চলই কালক্রমে বঙ্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। তাছাড়া কোনাে কোনাে ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, বাংলাদেশের আদিমতম জনগােষ্ঠি সাঁওতাল, কোল ও মুন্ডাদের এক দেবতার নাম হলাে ‘বােঙ্গা’। এই বােঙ্গা থেকেও বঙ্গ নামের উৎপত্তি হতে পারে।
খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে ঋগ্বেদে ‘বঙ্গ’ শব্দের উল্লেখ নেই। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে মুনি কর্তৃক রচিত ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে বঙ্গ নামের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সুপ্রাচীন বঙ্গ দেশের সীমা সম্পর্কে ড. নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয় হতে নেপাল, সিকিম ও ভুটান রাজ্য, উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারভঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভূমি, পূর্ব দিকে গারাে খাসিয়া জয়ন্তিয়া, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণি বেয়ে দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত; পশ্চিমে রাজমহল সঁওতাল পরগনা, ছােটনাগপুর, মানভূম ধলভূম, কেয়ঞ্জর, ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এই প্রাকৃতিক শিলা বিধৃত ভূখণ্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাংলার গৌড়-পুণ্ড্র- বরেন্দ্রীয়-রাঢ়-সূহ্ম-তাম্রলিপ্তি- বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ।”
সপ্তম শতাব্দিতে বাংলার প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা শশাংক এই জনপদগুলােকে গৌড় নামে একত্রিত করেন। এরপর বঙ্গদেশ পুন্ড্র, গৌড় ও বঙ্গ এই তিন জনপদে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মুসলিম ইতিহাসবিদ মিনহাজ-ই-সিরাজ ‘মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের ইতিহাস’ গ্রন্থে বরেন্দ্র-রাঢ় এবং বঙ্গ নামে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। তার লেখাতে লখনৌতি ও বঙ্গকে পৃথক অঞ্চল হিসেবে পাওয়া যায়। বঙ্গের সাথে সমতট এর উল্লেখও তাঁর লেখাতে আছে। ইতিহাসবিদ শামস-ই-সিরাজ আফিফের তারিখ-ই-ফিরােজশাহিতে বঙ্গ ও বাঙাল-কে পৃথক অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শামস-ই-সিরাজ সুলতান শামস উদ্দীন ইলিয়াস শাহকে শাহ-ই-বাঙালা রূপে আখ্যায়িত করেছেন। ইতিহাসে মুসলমান শাসক হিসেবে তিনিই সর্বপ্রথম বাংলার সমগ্র ভূখণ্ডে দীর্ঘকাল শাসন করেছেন।
সম্রাট আকবর-এর শাসনামলে সমগ্র বঙ্গদেশ ‘সুবহ-ই-বঙ্গালহ’ নামে পরিচিত হয়েছিল। বাঙালা নামটি মুসলমান শাসকদের সৃষ্টি।
সুতরাং ফারসি বঙ্গালহ শব্দ থেকে পর্তুগীজ 0Bengala এবং ইংরেজি Bengal শব্দ এসেছে। পরবর্তীকালে বাঙালা কিংবা বাংলা যা ব্রিটিশ শাসকগণ ইংরেজি ভাষায় বেঙ্গাল (Bengal) এবং ভাষাকে বেঙ্গালী (Bengali) বলেই প্রায় দু’শ বছর চালিয়েছে।
Q10. বাংলাদেশের ভূমির গঠন
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে বাংলাদেশ অবস্থিত। ২০°৩৪ উত্তর অক্ষরেখা থেকে ২৬°৩৮ উত্তর অক্ষরেখা এবং ৮৮°০১ পূর্ব দ্রাঘিমারেখা থেকে ৯২°৪১ পূর্ব দ্রাঘিমারেখা পর্যন্ত বাংলাদেশের বিস্তৃতি। বাংলাদেশের প্রায় মধ্য দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। এদেশের মোট আয়তন প্রায় ১,৪৭,৬১০ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে ভারত, দক্ষিণ-পূর্বে মায়ানমার এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।
ভূপ্রকৃতি
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। এদেশের ভূখণ্ড উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু। পূর্বে সামান্য উচ্চভূমি ছাড়া সমগ্র দেশ বিস্তীর্ণ সমভূমি।
শ্রেণীবিভাগ: ভূমির বন্ধুরতার পার্থক্য ও গঠনের সময়ানুক্রমিক দিক থেকে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(১) টারশিয়ারী যুগের পাহাড়সমূহ,
(২) প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ বা চত্বরভূমি ও
(৩) সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি।
(১)টারশিয়ারী যুগের পাহাড়সমূহ: টারশিয়ারী যুগে হিমালয় পর্বত গঠনের সময় এসব পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল বলে এগুলোকে টারশিয়ারী পাহাড় বলে। এ পাহাড়ী অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-(ক) উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ ও
(খ) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ।
উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ: ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার উত্তরাংশ, সিলেট জেলার উত্তর ও উত্তরপূর্বাংশ এবং মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের দক্ষিণাংশের ছোটবড় বিচ্ছিন্ন পাহাড়গুলো এ অঞ্চলের অন্তর্গত। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের দক্ষিণের পাহাড়গুলোর উচ্চতা ২৪৪ মিটারের বেশি নয়। শেরপুর ও ময়মনসিংহের উত্তর সীমানায় কিছু কিছু পাহাড় আছে। উত্তরের পাহাড়গুলোর মধ্যে চিকনাগুল, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া উল্লেখযোগ্য।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ: খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা এবং চট্টগ্রামের অংশবিশেষ এ অঞ্চলের অন্তর্গত। এ পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ৬১০ মিটার। বাংলাদেশের শৃঙ্গ কিওক্রাডং (উচ্চতা ১,২৩০ মিটার) এ অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। সাম্প্রতিককালে বান্দরবানে আরো একটি শৃঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর নাম তাজিওডং (বিজয়) এবং উচ্চতা ১,২৩১ মিটার। এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এই অঞ্চলের অপর দুইটি উচ্চতার পাহাড় চূড়া হচ্ছে মোদকমুয়াল (১,০০০ মিটার) ও পিরামিড (৯১৫ মিটার)। এসব পাহাড় বেলেপাথর, শেল ও কর্দম শিলা দ্বারা গঠিত। এ অঞ্চলে পাহাড়গুলোর মধ্যবর্তী উপত্যকা দিয়ে কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা প্রভৃতি নদী প্রবাহিত হয়েছে।
(২)প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ বা চত্বরভূমি: ২৫,০০০ বছর পূর্বে প্লাইস্টোসিনকালে আন্তঃবরফগলা পানিতে প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে এসব চত্বরভূমি গঠিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এ অঞ্চলের মাটির রং লাল ও ধূসর। নিচে এ উচ্চভূমিগুলোর বর্ণনা দেওয়া হল।
বরেন্দ্রভূমি: বরেন্দ্রভূমি রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৯,৩২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আছে। প্লাবন সমভূমি থেকে এর উচ্চতা ৬ থেকে ১২ মিটার। মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়: উত্তরের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত অর্থাৎ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর অঞ্চলজুড়ে এর বিস্তৃতি। (৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি) এর মোট আয়তন প্রায় ৪,১০৩ বর্গ কিলোমিটার। মাটি কংকর মিশ্রিত ও লাল। গড়ের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশের উচ্চতা ৬ মিটার কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর দিকের উচ্চতা ৩০ মিটার।
লালমাই পাহাড়: এটি লালমাই থেকে ময়নামতি পর্যন্ত বিস্তৃত। এর আয়তন প্রায় ৩৪ বর্গ কিলোমিটার। এ পাহাড়ের গড় উচ্চতা ২১ মিটার। এর মাটি লালচে এবং নুড়ি, বালি ও কংকর দ্বারা গঠিত।
(৩) সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি
বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ভূমি এ অঞ্চলের আওতায় পড়ে। এ অঞ্চল পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা প্রভৃতি নদী এবং এদের উপনদী ও শাখানদী বাহিত পলি দ্বারা গঠিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ সমভূমির গড় উচ্চতা ৯ মিটারের কম। এ অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে অসংখ্য বিল ও জলাভূমি ছড়িয়ে আছে। এগুলো এদেশে ভূপ্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। রাজশাহী ও পাবনার চলন বিল, মাদারিপুরের বিল ও সিলেটের হাওরগুলো বর্ষার পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে হ্রদের আকার ধারণ করে। এ সমভূমি অঞ্চলের ভূমি খুব উর্বর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন